চিনের ম্যান্ডারিন ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করো

   চিনের প্রাচীন আমলাতন্ত্র :- 

( 1 ) প্রাচীন আমলাতান্ত্রিক কর্মচারী :- আজ থেকে অন্তত ৩০০০ বছর পূর্বে চিনের প্রশাসনিক কাজে আমলাতান্ত্রিক কর্মচারী ব্যবস্থা গড়ে ওঠে । প্রাচীন ঝৌ ( Zhou ) বংশের ( ১০৪৬-২৫৬  খ্রিস্টপূর্ব ) শাসনকালে চিনের প্রশাসনে আমলাতান্ত্রিক কর্মচারীদের অস্তিত্ব ছিল । অবশ্য তখন আমলাতন্ত্রের বেশিরভাগ উচ্চপদ সর্বোচ্চ শাসকের অর্থাৎ সম্রাটের আত্মীয় এবং অভিজাত শ্রেণির লোকেরা লাভ করত । 

( 2 ) সম্রাট - কর্মচারী আতঙ্ক :- অবশ্য সেই সময় সম্রাট এবং পদস্থ কর্মচারী উভয় পক্ষের সম্পর্কে কখনো কখনো আতঙ্কের বাতাবরণ তৈরি হত । কারণ , একদিকে আমলারা সম্রাটের স্বৈরাচারী মানসিকতায় আতঙ্কিত থাকত , অন্যদিকে আমলারা সম্রাটকে এড়িয়ে জনগণকে বেশি গুরুত্ব দিতে পারে এই ভয়ে স্বয়ং সম্রাট ভীত থাকতেন ।

( 3 ) কাজ :- যাই হোক , এই সকল আমলারা স্থানীয় ভূস্বামী ও শাসক হিসেবে কাজ করতেন ,ka রাজস্ব আদায় করতেন এবং জনগণ ও সম্রাটের মধ্যে যোগসূত্র রক্ষা করতেন ।


 ম্যান্ডারিনের উত্থান :-

( 1 ) সম্রাটের সর্বোচ্চ ক্ষমতা :-  চিনের পিকিং - এ সম্রাট ও কেন্দ্রীয় সংগঠনকে নিয়ে চিনের কেন্দ্রীয় সরকার গড়ে উঠেছিল । কেন্দ্রীয় সরকারে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন স্বয়ং চিনা সম্রাট । তাকে স্বর্গের সন্তান বলে মনে করা হত । তিনি ‘ স্বর্গীয় অনুশাসন ' ( Mandate of Heaven ) এবং রাজবংশের প্রচলিত আইন মেনে তাঁর ক্ষমতা প্রয়োগ করতেন ।

( 2 ) নতুন আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা :- পরবর্তীকালে চিনের পদস্থ সরকারি কর্মচারি কাঠামোয় নানা বিবর্তন ঘটে । তাং ( Tang ) বংশের ( ৬১৮-৯০৭ খ্রি . ) রাজত্বকালে পূর্বের প্রচলিত নয় - স্তরীয় ব্যবস্থা ( Nine - Rank System ) বাতিল করে চিনে নতুন আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয় । এই নতুন আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ম্যান্ডারিন পদটি যথার্থ রূপ লাভ করে ।

( 3 ) ম্যান্ডারিন :-  নতুন এই আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নতুন ধরনের সরকারি কর্মচারী নিয়োগ করা হয় । এই সরকারি কর্মচারীদের বলা হত ম্যান্ডারিন ( Mandarin ) এই সরকারি কর্মচারীরা সম্রাটের কাজের অংশীদার হিসেবে চিনা সমাজে স্বর্গীয় অনুশাসন চালু করে সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতেন । সপ্তম শতকের শুরু থেকে বিশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত প্রায় ১৩০০ বছর ধরে চিনের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ম্যান্ডারিন নামে পদস্থ কর্মচারীদের অস্তিত্ব ছিল ।

  শব্দার্থ :-

( 1 ) শব্দের উৎপত্তি :-  mandarin শব্দটি মালয় শব্দভাণ্ডার থেকে পোর্তুগিজ ভাষায় প্রবেশ করেছে এবং পোর্তুগিজ শব্দ mandarim থেকে ইংরেজি mandarin শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে বলে মালয়েশিয়ার অধ্যাপক উচ্ছু আবদুল আজিজ ( Ungku Abdul Aziz ) মনে করেন । ষোড়শ শতক নাগাদ ম্যান্ডারিন শব্দটি ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় ছড়িয়ে পড়ে ।

( 2 ) আধুনিক অর্থ :-  বর্তমান কালে অনেক সময়ই ইংরেজি mandarin শব্দটির দ্বারা উচ্চ বা যে কোনো স্তরের প্রশাসনিক কর্তাকে বোঝানো হয়ে থাকে । কখনো কখনো পদস্থ সরকারি কর্মচারীদের প্রতি বিদ্রুপাত্মক অর্থেও mandarin শব্দটি বর্তমানে ব্যবহার করা হয় ।



যোগ্যতা :-

( 1 ) পণ্ডিত - আমলা :-  "ম্যান্ডারিন11"  শব্দটির দ্বারা চিনা প্রশাসনের পণ্ডিত কর্মচারী বা পণ্ডিত আমলাদের ( The Scholar - Bureaucrats ) বোঝানো হয় যিনি প্রশাসনের কার্য সম্পাদনের সেে নিজেকে কাব্য , সাহিত্য এবং কনফুসীয় শিক্ষায় নিয়োজিত রাখেন । ম্যান্ডারিন পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে জন্ম , বংশ - কৌলীন্য ও সম্পত্তির পরিবর্তে যোগ্যতা ও শিক্ষাদীক্ষা বিচার করা হত ।



( 2 ) পরীক্ষা :-  ম্যান্ডারিন পদপ্রার্থীদের কঠিন যোগ্যতা নির্ণায়ক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হত । তাঁদের কনফুসীয় আদর্শ সম্পর্কে গভীর জ্ঞান যাচাই করা হত । এ ছাড়া সাহিত্য ও কাব্যচর্চা , রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা প্রভৃতি বিষয়ে প্রার্থীর যথেষ্ট জ্ঞান থাকা আবশ্যিক ছিল । তাদের অবশ্যই ধ্রুপদি চিনের ঐতিহ্য সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হত । অবশ্য চিনের সকলের জন্য ম্যান্ডারিনের পদলাভের সুযোগ ছিল না । পাহারাদার , অপরাধী , শ্রমিক , জেল খাটা আসামি , অভিনেতা , সংগীতজ্ঞ , ক্রীতদাস ভিক্ষুক প্রমুখ ম্যান্ডারিন হিসেবে নিয়োগের পরীক্ষায় বসার যোগ্য ছিল না । 

( 3 ) নিয়োগ ও পদচ্যুতি :-  পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের স্থানীয় প্রাদেশিক এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ করা হত । অবশ্য কোনো কোনো উচ্চপদস্থ ম্যান্ডারিন সম্রাটের ইচ্ছায় বহাল হতেন । মিং বংশের ( ১৩৬৮-১৬৪৪ খ্রি . ) শাসনকালে চিনে রাজতন্ত্রের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় । এই বংশের রাজারা তাদের অপছন্দের উচ্চপদস্থ ম্যান্ডারিন , এমনকি প্রধানমন্ত্রীকেও তাদের পদ থেকে সরিয়ে দিতেন । ম্যান্ডারিনদের মধ্যে যাতে স্থানীয় স্বার্থ গড়ে না ওঠে সেজন্য আইনের মাধ্যমে এই কর্মচারীদের তাদের নিজস্ব এলাকার বাইরে নিয়োগ করা হত । এর ফলে তারা সাম্রাজ্যের স্বার্থ - বিরোধী কোনো কাজকর্মে লিপ্ত হওয়ার সুযোগ পেতেন না । কোনো একজন ম্যান্ডারিনের ক্ষমতা অন্য একজন ম্যান্ডারিনের ক্ষমতার দ্বারা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাও ছিল ।


  কার্যাবলি :-

ম্যান্ডারিনরা চিনের কেন্দ্রীয় সরকারের সচিবালয়ের অধীনে কাজ করতেন ।

( 1 ) কঠোর পরিশ্রম :-  প্রশাসনের প্রধান আমলা হিসেবে ম্যান্ডারিনদের কঠোর পরিশ্রম করতে হত । ভোর পাঁচটায় তাদের কাজ শুরু হত । প্রশাসনের যাবতীয় কাজ তাঁরা পরিচালনা করতেন । 

( 2 ) রাজাকে সহায়তা :-  চিনে মাঞ্চু রাজবংশের আমলের প্রথমদিকে ম্যান্ডারিনদের কাজ ছিল সম্রাটকে সমস্ত বিষয়ে সহায়তা করা ।

( 3 ) অন্যান্য কাজ :-  প্রশাসনিক কাজকর্ম ছাড়াও সরকারের অন্যান্য কাজকর্মও ম্যান্ডারিনদের করতে হত । তাঁরা ব্যাবসাবাণিজ্যের কাজের তদারকি করতেন , অর্থের জোগান সচল রাখতেন , প্রদেশের নিরাপত্তা বজায় রাখতেন ইত্যাদি ।

( 4 ) পুরস্কার :- যে সকল ম্যান্ডারিন খুব ভালো কাজ করতেন তাঁদের পুরস্কার প্রদান করা হত ।


   বিভিন্ন স্তর :-

( 1 ) মর্যাদা :-  ম্যান্ডারিনরা চিনের কেন্দ্রীয় ক্ষমতার খুব কাছাকাছি অবস্থান করতেন বলে সমাজে তাদের খুবই সম্মানীয় স্থান ছিল । কিং বংশের ( ১৬৪৪ ১৯১১ খ্রি . ) রাজত্বকালে চিনের সামাজিক ক্ষেত্রে ম্যান্ডারিনদের মর্যাদা সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছোয় ।

( 2 ) জীবনযাপন :-  ম্যান্ডারিনরা বিলাসবহুল জীবনযাপন করতেন এবং বহুমূল্য পোশাক পরিধান করতেন । মূল্যবান ধাতুর অলংকারযুক্ত ও রত্নখচিত পোশাক ম্যান্ডারিনদের পদমর্যাদা নির্দেশ করত ।

( 3 ) উচ্চপদস্থ ম্যান্ডারিন :-  চিনের প্রশাসনে ম্যান্ডারিনদের বিভিন্ন স্তরভেদ ছিল সর্বোচ্চ স্তরের ম্যান্ডারিন চিনা সম্রাটের প্রধানমন্ত্রীর সমগোত্রীয় পদ লাভ করতেন । চিনের বিভিন্ন প্রদেশের প্রাদেশিক শাসক বা গভর্নর পদেও উচ্চপদস্থ ম্যান্ডারিনদের নিয়োগ করা হত । উচ্চপদস্থ ম্যান্ডারিনরা দামি পদ্মরাগমণিযুক্ত টুপি পরিধান করতেন ।

( 4 ) সাধারণ ম্যান্ডারিন :-  সাধারণ ও নিম্ন স্তরের ম্যান্ডারিনরা প্রবাল , লাপিস লাজুলি , সোনা , ৰূপা প্রভৃতির দ্বারা নির্মিত টুপি ব্যবহার করতেন ।


   অবসান :-

( 1 ) স্থায়িত্ব :-  সাম্রাজ্যের যুগে চিনের দীর্ঘকালীন অস্তিত্ব এবং প্রশাসনিক সাফল্য অনেকটাই ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল ছিল । চিনে রাজবংশ ও সাম্রাজ্যের পতন ঘটলেও সুশিক্ষিত ম্যান্ডারিনদের নিয়ে গড়ে ওঠা এই আমলাতন্ত্র চিনা প্রশাসনে দক্ষতা ও স্থায়িত্ব দান করেছিল । 

( 2 ) বিশিষ্ট সম্প্রদায় :-  চিনের ম্যান্ডারিনরা সেদেশের বিশিষ্ট সম্প্রদায় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে । ম্যান্ডারিনদের মধ্যে থেকে পরবর্তীকালে চিনের জেন্ট্রি সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে ।

( 3 ) ক্ষমতা হ্রাস :-  যাই হোক , চিনে ১৭২৯ খ্রিস্টাব্দে ' Grand Council ' গঠিত হলে ম্যান্ডারিনদের ক্ষমতা ও দায়িত্ব অনেকাংশে হ্রাস পায় ।

( 4 ) আধুনিক আমলাতন্ত্র :-  এরপর ঊনবিংশ শতকে চিনের প্রশাসনে আধুনিক রাষ্ট্রনীতির ঢেউ লাগে । ফলে প্রাচীন ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার স্থলে আধুনিক ইউরোপীয় ধাঁচের আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রয়োজন দেখা দেয় ।

( 5 ) ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার অবসান :-  শেষপর্যন্ত পাশ্চাত্য শিক্ষাধারার চাপে চিনে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে ম্যান্ডারিনদের নিয়োগ সংক্রান্ত পরীক্ষার অবসান ঘটে এবং কিং বংশের পতনের ( ১৯১১ খ্রি . ) পর চিনের সমগ্র ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার অবসান ঘটে । এরপর চিনে আধুনিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে । চিনের শেষ পর্বের ম্যান্ডারিনদের মধ্যে অন্যতম ম্যান্ডারিন ছিলেন লিং চু চুয়ান ( Ling Chu - Chuan ) ।

  ম্যান্ডারিন শাসনব্যবস্থার মূল্যায়ন :-

 A. ত্রুটি : চিনের ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার প্রধান ত্রুটিগুলি ছিল –

( 1 ) সন্দেহপ্রবণতা :-  ম্যান্ডারিনদের ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে চিনের শাসক সম্প্রদায় চিন্তায় পড়ে যান । ফলে ম্যান্ডারিনদের ক্ষমতা খর্ব করার বিষয়কে কেন্দ্র করে রাজা ও ম্যান্ডারিনদের মধ্যে সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল । চিনের প্রশাসনে এর ক্ষতিকারক প্রভাব পড়েছিল ।

( 2 ) প্রশাসনিক স্থবিরতা :-  অনেকে সমালোচনা করে থাকেন যে , ম্যান্ডারিন ব্যবস্থা চিনের প্রশাসনে বিরাট কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি । ফলে প্রশাসনের অগ্রগতি ব্যাহত হয়েছিল । 

( 3 ) সাধারণ মানুষের প্রতি উদাসীনতা :-  ম্যান্ডারিনদের সঙ্গে চিনের সাধারণ মানুষের বিশেষ কোনো যোগসূত্র গড়ে ওঠেনি । ফলে সাধারণ মানুষের চাহিদা ও অধিকার অনেকাংশেই পূরণ হয়নি ।

( 4 ) নিয়োগ পদ্ধতির ত্রুটি :-  চিনের প্রজাদের একটি বড়ো অংশের মানুষ ম্যান্ডারিন হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার অধিকার থেকে বর্ণিত হয়েছিল ।

 B. গুরুত্ব : চিনের সুপ্রাচীন ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার বিভিন্ন গুরুত্ব ছিল । যেমন –

( 1 ) উন্নত প্রশাসনিক ব্যবস্থা :- ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার মাধ্যমে চিনে আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল তা ছিল যথেষ্ট উন্নত ।

( 2 ) যোগসূত্র রক্ষা :-  ম্যান্ডারিনরা চিনের স্থানীয় শাসক ও রাজার মধ্যে যোগসূত্র রক্ষার কাজ করত । ফলে সেখানে প্রশাসনিক ব্যবস্থায় সর্বনিম্ন থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়েছিল ।

( 3 ) অত্যধিক শ্রমদান :-  ম্যান্ডারিনরা কঠোর পরিশ্রম করতেন এবং দিনের বেশিরভাগ সময় কাজে নিযুক্ত থাকতেন । ফলে প্রশাসনে গতি এসেছিল বলে অনেকে মনে করেন ।

( 4 ) বিভিন্ন ধরনের কার্য :-  শাসন পরিচালনা করা ছাড়াও ম্যান্ডারিনরা দেশের নিরাপত্তা , ব্যাবসাবাণিজ্য প্রভৃতি বহুবিধ কাজ করতেন । ফলে প্রশাসনে উৎকর্ষ এসেছিল ।



  More post👇










Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.