ভূমিকা :-
উনিশ শতকে ভারতবাসীর দুরবস্থা দূর করার্ জন্য জাতীয় জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে সংস্কার সাধনের চেষ্টা হয় । ফলে ভারতে নবজাগরণের সূচনা ঘটে । যেহেতু বাংলা দেশে এই সমস্ত উপাদানগুলি প্রবল ছিল তাই নবজাগরণের সূচনা বাংলা দেশেই প্রথম হয় ।
বাংলার নবজাগরণের প্রকৃতি, সীমাবদ্ধতা গুরুত্ব প্রভৃতি বিষয়েও পণ্ডিতদের মধ্যে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে । যেমন —
(ক) বাস্তব নবজাগরণ :-
উনিশ শতকে বাংলায় প্রকৃতই নবজাগরণ ঘটেছিল বলে অনেকেই মনে করেন । বাংলার সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক জাগরণকে স্যার যদুনাথ সরকার প্রমুখ ঐতিহাসিকেরা ইটালির নবজাগরনের চেয়ে ব্যাপক গভীর ও বৈপ্লবিক বলে উল্লেখ করেছেন ।
(খ) বাংলার নবজাগরণ প্রকৃত নবজাগরণ নয় :-
অনেক ঐতিহাসিক বাংলার নবজাগরণের কথা স্বীকার করলেও অনেকে আবার একে প্রকৃত নবজাগরণ বলতে রাজি নন । যেমন —
a. তথাকথিত নবজাগরণ :-
প্রখ্যাত পণ্ডিত অশোক মিত্র ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে আদমশুমারি তৈরির সময় বাংলার উনিশ শতকে নবজাগরণকে 'তথাকথিত নবজাগরণ' (So Called Renaissance) বলে অভিহিত করেছেন ।
b. ইউরোপীয় নবজাগরণের সমতুল্য নয় :-
ইউরোপের নবজাগরণ ছিল সামন্তপ্রথার বিরুদ্ধে কিন্তু বাংলার নবজাগরণ ছিল জমিদার ও মধ্যসত্ত্ব ভোগীদের একত্রিত হয়ে সামন্ত তান্ত্রিক ভূস্বামীদের আন্দোলন ।
C. ঐতিহাসিক প্রতারণা :-
ঐতিহাসিক বিনয় ঘোষ তাঁর "বাংলার নবজাগতিক" গ্রন্থে বলেছেন, “উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণ ছিল একটি মিথ্যাচার” । নবজাগরণকে তিনি একটি "ঐতিহাসিক প্রতারণা" বলে অভিহিত করেছেন ।
(গ) নবজাগরণের সীমাবদ্ধতা :-
উনিশ শতকে বাংলার বেশ কিছু সীমাবন্ধতা লক্ষণীয় । যথা —
(১) ইটালির ফ্লোরেন্স ছিল স্বাধীন নগরী । অপরদিকে কলকাতা গড়ে উঠেছিল সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের ঔপনিবেশিক কেন্দ্র হিসেবে । স্বভাবতই ফ্লোরেন্সের মতো স্বাধীন মানসিকতা ও শিল্পীমন কলকাতার ছিল না ।
(২) উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণ ছিল মূলত শহরকেন্দ্রিক । কৃষক - শ্রমিক সহ সমাজের একটি বড়ো অংশ এই নবজাগরণের শহিত হতে পারেনি ।
(৩) বাংলার নবজাগরণ ছিল মূলত বর্ণ - হিন্দুদের মুসলিম সমাজ এর বাইরে ছিল ।
(৪) বাংলার নবজাগরণের প্রবক্তরা বাংলার সমাজকাঠামো, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, জাতিভেদ প্রথা প্রভৃতি ক্ষেত্রে পুরোপুরি সাফল্য লাভ করতে পারেননি ।
(৫) বাংলার নবজাগরণ মূলত সমাজের উচ্চশিক্ষিত ও উচ্চবিত্তদের মধ্যেই প্রসারিত হয়েছিল ।
উপসংহার :-
উনিশ শতকে নবজাগরণের ফলে বাংলার ধর্ম ও সমাজে আধুনিকতার সঞ্চার হয়েছিল । ভারতীয়রা পাশ্চাত্য জ্ঞান - বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অবহিত হওয়ার সুযোগ পায় । পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে সময়, স্বাস্থ্য এবং শ্রমিকের পারিশ্রমিকের যে - ধারণা প্রচলিত ছিল, তার সম্বন্ধে ভারতীয়রা জানতে পারে ।