📌 চিনের ওপর আরোপিত বিভিন্ন অসম চুক্তিগুলির সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো
।
অথবা,
প্রথম আফিমের যুদ্ধ এবং দ্বিতীয় আফিমের যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল বর্ণনা
করো ।
👉🏼 পশ্চিমি শক্তিগুলির সঙ্গে স্বাক্ষরিত চিনের এই চুক্তিগুলিকে অনেকেই চিনের
'শতাব্দীব্যাপী অবমাননা' বলে অভিহিত করেছেন । বিভিন্ন ঐতিহাসিক চিনের ওপর আরোপিত
যে সমস্ত অসম চুক্তিগুলি উল্লেখ করেছেন তা হল —
( ১ ) প্রথম আফিমের যুদ্ধ ও নানকিং - এর চুক্তি :-
১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে চিন
সম্রাট চিয়াং চিং চিনে আফিং ব্যবহার, আমদানি ও চাষ বেআইনি ঘোষণা করলেও বাণিজ্যিক
স্বার্থে এবং প্রচুর মুনাফার লোভে ইংল্যান্ড বেআইনি আফিং বাণিজ্য চালিয়ে যায় ।
ফলে আফিম ব্যাবসাকে কেন্দ্র করে চিন ও ইংল্যান্ডের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে যা প্রথম
আফিমের যুদ্ধ নামে পরিচিত । এই চুক্তির দ্বারা —
( ক ) চিন হংকং বন্দরটি ইংল্যান্ডকে ছেড়ে দেয় ।
( খ ) ক্যান্টন, সাংহাই, অ্যাময়, ফুচাও, নিংগপো— এই পাঁচটি
বন্দর ইউরোপীয়দের বাণিজ্য ও বসবাসের জন্য খুলে দেওয়া হয় ।
( গ ) চিন ক্যান্টন বন্দরে বাজেয়াপ্ত আফিমের মূল্য, কো - হো -
এর কাছে প্রাপ্য অর্থ এবং যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ ২১,০০০০০০ ব্রিটিশ স্টার্লিং
পাউন্ড দিতে বাধ্য হয় ।
( ঘ ) 'কো - হং’ প্রথা বাতিল হয় এবং চিনের সর্বত্র ইংরেজ
বণিকদের পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের অধিকার স্বীকৃত হয় ।
(২) বগ - এর অসম চুক্তি :-
১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে ৮ অক্টোবর চিনের ওপর "বগ
-এর সন্ধি" নামে অপর একটি অসম চুক্তি চাপিয়ে দেয় । এই সন্ধির দ্বারা —
( ক ) ব্রিটেন চিনে কিছু অতি–রাষ্ট্রিক অধিকার লাভ করে ।
( খ ) চিন অন্য কোনো বিদেশি রাষ্ট্রকে ভবিষ্যতে যেসব সুযোগ
সুবিধা দেবে সেগুলি ব্রিটেনকেও দিতে রাজি হয় ।
(৩) ওয়াংঘিয়া -র অসম চুক্তি :-
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুর্বল
চিনের কাছ থেকে কিছু বাণিজ্যিক সুযোগসুবিধা লাভের জন্য "ওয়াংঘিয়া -র অসম
চুক্তি" চাপিয়ে দেয় । এই চুক্তি দ্বারা —
( ক ) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চিনের কাছ থেকে বিভিন্ন অতিরাষ্ট্রিক সুবিধা
লাভ করে ।
( খ ) চিনের চুক্তি বন্দরগুলিতে বসবাসকারী বিদেশিরা আইনগত,
বিচারবিভাগীয়, পুলিশ -সংক্রান্ত এবং কর -সংক্রান্ত বিষয়ে স্বাধীনতা লাভ করে
।
(৪) হোয়ামপোয়া - র অসম চুক্তি :-
ফ্রান্স বাণিজ্যিক
সুযোগসুবিধা লাভের জন্য চিনের ওপর "হোয়ামপোয়া" -নামক অসম চুক্তি চাপিয়ে
দেয় । এই চুক্তি দ্বারা —
( ক ) ফরাসি বনিকদের জন্য চিনের নতুন পাঁচটি বন্দর খুলে দেওয়া হয় ।
( খ ) চিন ও ফরাসি বণিকদের মধ্যে বাণিজ্য শুল্ক নির্দিষ্ট হয়
।
( গ ) ফ্রান্স বিভিন্ন অতিরাষ্ট্রিক অধিকার লাভ করে ।
(৫) আইগুন -এর সন্ধি :-
১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়া চিনকে বাধ্য
করেছিল এই সন্ধি স্বাক্ষর করতে । এর শর্ত দ্বারা স্থির হয়—
( ক ) আমুর নদীর উত্তর দিকের সমস্ত চিনা জমিতে রাশিয়ার কর্তৃত্ব
স্থাপিত হবে ।
( খ ) রাশিয়ার বাণিজ্যের জন্য চিন উর্গা ও কাশগড় উন্মুক্ত করে
দেবে ।
(৬) দ্বিতীয় আফিমের যুদ্ধ ও তিয়েনসিন -এর চুক্তি :-
১৮৫৬
খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স চিনের বিরুদ্ধে যে - যুদ্ধ সংঘটিত করে তা
দ্বিতীয় আফিমের যুদ্ধ নামে পরিচিত । এই যুদ্ধে চিন পরাজিত হয়ে ১৮৫৮
খ্রিস্টাব্দে জুন মাসে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের সঙ্গে তিয়েনসিনের অসম চুক্তি
স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয় । এই সন্ধির শর্ত দ্বারা —
( ক ) বিদেশি বণিকদের জন্য চিনকে আরও ১১ টি বন্দর খুলে দিতে হয় ।
( খ ) বিদেশিরা চিনের যে-কোনো জায়গায় ভ্রমণ ও বসবাসের অধিকার
পায় ।
( গ ) আফিম ব্যাবসাকে আইনসম্মত করা হয় ।
( ঘ ) বিদেশি ধর্মপ্রচারকরা চিনের সর্বত্র ধর্মপ্রচারের অধিকার
পায় ।
( ঙ ) রাজধানী পিকিং -এ বিদেশি দূতাবাস স্থাপনের প্রতিশ্রুতি
দেওয়া হয় ।
(৭) পিকিং -এর সন্ধি :-
চিন সম্রাটের ভাই কুং ইংল্যান্ড
ও ফ্রান্সের সঙ্গে পিকিং - এর সন্ধি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন । এই সন্ধির
শর্তানুসারে —
( ক ) তিয়েনসিন বিদেশিদের জন্য উন্মুক্ত হয় ।
( খ ) ব্রিটেন চিনের কওলুন উপদ্বীপ লাভ করে ।
( গ ) চিন ৮ মিলিয়ন টেইল ক্ষতিপূরণ দেবে বলে রাজি হয় ।
(৮) শিমনোসেকির সন্ধি :-
চিন পরাজিত হয়ে ১৮৯৫
খ্রিস্টাব্দে জাপানের সঙ্গে অপমানজনক শিমনোসেকির সন্ধি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয় ।
শর্তানুসারে —
( ক ) কোরিয়াকে চিন স্বাধীনতা দেয় ।
( খ ) চিনের কাছ থেকে জাপান পেস্কাডোরেস, তাইওয়ান, লিয়াও টুং
উপদ্বীপ ও পোর্টআর্থার লাভ করে ।
( গ ) চিন তার বেশ কয়েকটি বন্দর জাপানের জন্য খুলে দিতে বাধ্য
হয় ।
(৯) বক্সার প্রোটোকল :-
শেষ পর্যন্ত চিনে অবস্থিত
বিদেশি শক্তিগুলির সম্মিলিত বাহিনী এই বিদ্রোহ দমন করে চিনের ওপর "বক্সার
প্রোটোকল" অসম চুক্তি চাপিয়ে দেয় । যার শর্তা ছিল —
( ক ) পিকিং - এ বিদেশি দূতাবাসগুলি রক্ষার জন্য বিদেশি সেনা মোতায়েন
করা হয় ।
( খ ) পরবর্তী দু - বছরের জন্য চিনে অস্ত্র নির্মাণ ও আমদানি
নিষিদ্ধ হয় ।
মূল্যায়ন :-
অসম চুক্তিগুলির মাধ্যমে ব্রিটেন, ফ্রান্স, আমেরিকার যে
অতিরাস্ট্রিক সুবিধাগুলি লাভ করেছিল তা প্রথম ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বজায় ছিল
। তবে রাশিয়া রুশ বিপ্লব কালে চিনের কাছ থেকে পাওয়া বিভিন্ন সুযোগসুবিধা ত্যাগ
করে ।