☀ বিশ্বায়নের প্রকৃতি ও ফলাফল ব্যাখ্যা করো ।
Ans. বিশ্বায়ন হল এমন একটি
আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে জাতি ও রাষ্ট্রের সাবেকি ধারণার অবসান ঘটিয়ে
একটি ‘ সীমারেখাহীন বিশ্ব গড়ে তোলা হয় । এই প্রক্রিয়ায় অর্থনৈতিক, সামাজিক,
রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিশ্বময় অবাধ আদানপ্রদানের পরিমণ্ডল গড়ে ওঠে
।
বিশ্বায়নের প্রকৃতিঃ
বিশ্বায়নের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে,
এর কয়েকটি রূপের সন্ধান পাওয়া যায় । সেগুলি হল —
1. অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন :-
বর্তমান বিশ্বে বিশ্বায়নের ধারণা মূলত আর্থনৈতিক ।
কোনো জাতীয় অর্থনীতিকে বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপের মতো সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বিষয়
হিসেবে বিবেচনা করা হয় না । সকল দেশের অর্থনীতি পরস্পর সংবদ্ধ ও বিশ্ব -
অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত । তাই স্বতন্ত্র জাতীয় অর্থনীতির ধারণা ছেড়ে
অখণ্ড বিশ্ব - অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সংযোগসাধনই হল অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন ।
2 রাজনৈতিক বিশ্বায়ন :-
রাজনৈতিক দিক থেকে বিশ্বায়ন
জাতিরাষ্ট্রগুলির সাবেকি ধারণাকে নস্যাৎ করেছে । উন্নত ও উপনিবেশবাদী রাষ্ট্রগুলি
উন্নয়নশীল দেশগুলির ওপর আধিপত্য কায়েম করে রাজ্যে বিশ্বায়নকে প্রতিষ্ঠিত করেছে
। ন্যূনতম রাষ্ট্রের ধারণার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি শ্রমিক সংগঠনের প্রতি অনীহা
রাজনৈতিক বিশ্বায়নের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ।
3. সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন :-
বিশ্বায়ন বিভিন্ন দেশের বহুমুখী
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সমূহকে এক ছাঁচে ঢেলে যে সমজাতীয় সংস্কৃতি নির্মাণ করতে চায়
তাকে "ম্যাকডোনাল্ড সংস্কৃতি" বলা হয় । বস্তুত, বিশ্বায়নের যুগে
বহুজাতিক সংস্থাগুলির একাধিপত্যে পশ্চিমি ভোগবাদী বিকৃত সংস্কৃতি প্রসারের
অন্তহীন প্রয়াস ।
4. পরিবেশগত দিক :-
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে বহুজাতিক
সংস্থাগুলির উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত শিল্পগুলিতে ব্যাপক পরিবেশদূষণ ঘটছে । উদাহরণ
স্বরূপ জৈব রসায়ন জাতীয় শিল্পের উল্লেখ করা যায় ।
বিশ্বায়নের ফলাফল :-
বিশ্বায়নের ফলাফল স্বরূপ ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিকই পরিলক্ষিত
হয় । যথাক্রমে, —
ইতিবাচক ক্ষেত্রে দেখা যায় –
( a ) দক্ষতা, তথ্যপ্রযুক্তি, যোগাযোগ প্রভৃতি ক্ষেত্রে
বিপ্লব ঘটিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ের নানান
সমস্যা সমাধানে এবং উন্নতিতে সচেষ্ট হয়েছে ।
( b ) বিশ্বায়ন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাধীনতার
ধারণাকে আরও প্রসারিত করেছে ।
( c ) বিশ্বায়ন যুদ্ধের ধ্বংসাত্মক পরিণাম সম্পর্কে জনগণকে সচেতন
করে তুলে আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠার সপক্ষে জনমত গড়ে তুলেছে ।
নেতিবাচক ক্ষেত্রে দেখা যায় –
( a ) দুর্বল রাষ্ট্রগুলির অর্থনতিক ব্যবস্থা বৃহৎ
পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় ।
( b ) ধনী ও দরিদ্র রাষ্ট্রগুলির মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য
বৃদ্ধি পেয়েছে ।
( c ) বিশ্বায়ন কেবলমাত্র পশ্চিমি ধ্যানধারণা , মূল্যবোধ ও
সংস্কৃতির সম্প্রসারণ ঘটায়, অ-পশ্চিমি মূল্যবোধকে গুরুত্ব দেয় না ।
( d ) বিশ্বায়নের ফলস্বরূপ শিল্পায়ন, নগরায়ণের যত প্রসার
ঘটছে , তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পরিবেশ দূষণ ।
তৃতীয় বিশ্বের ওপর বিশ্বায়নের প্রভাব :-
যেহেতু তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ
মানুষই মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত এবং দরিদ্র তাই বিশ্বায়নের প্রভাবে আক্রান্ত
হয়েছেন সেই মানুষগুলি । পুঁজিবাদী মানসিকতার পীড়নে নিপীড়িত হচ্ছে তৃতীয়
বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলি । শ্রমিক কর্মচারীদের মজুরি হ্রাস থেকে শুরু করে দেশীয়
মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটে চলেছে ।
উপসংহার :-
এ কথাও অস্বীকার করা যায় না যে তৃতীয় বিশ্বের
দেশগুলির ওপর বিশ্বায়নের প্রভাব রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতাকেও প্রশ্নচিহ্নের সামনে
এনে দাঁড় করিয়েছে । তাই আপাত ইতিবাচক তথা ভোগ্যপণ্যের হাতছানির লোলুপতার আড়ালে
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির ক্ষেত্রে বিশ্বায়ন নেতিবাচক দিকটিকেই প্রকট করেছে ।