Ans. সংজ্ঞা :-
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক হল এমন একটি শাস্ত্র যা বিভিন্ন রাষ্ট্রের
পারস্পরিক সম্পর্ক এবং বিভিন্ন অরাষ্ট্রীয় সংস্থা ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের
রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক, কুটনৈতিক প্রভৃতি সকল প্রকার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা
করে ।
ভূমিকা :-
হফম্যান আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন,
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এমন উপাদান ও ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে যুক্ত, যা
রাষ্ট্রের
|
ফিলিপ সিমোর হফম্যান |
বাহ্যিক নীতি ও ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে । আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি
সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা হিসেবে বলা যায়, যে শাস্ত্র রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের
সম্পর্ক, রাজনৈতিক মতাদর্শ, ক্ষমতা, জাতীয় স্বার্থ, আন্তর্জাতিক সংগঠন,
বিশ্বায়ন প্রভৃতি যা বিশ্বরাজনীতিকে প্রভাবিত করে, এমন সব বিষয় নিয়ে আলোচনা
করে, তাকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বলে ।
1948 খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের প্যারিসে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্মেলনে
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ শাখা হিসেবে
'আন্তর্জাতিক সম্পর্ক' স্বীকৃতি লাভ করে । প্রকৃতপক্ষে আন্তর্জাতিক
সম্পর্ক শাস্ত্রটির বিকাশ ঘটেছে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন তাত্ত্বিক ধারণার মধ্য
দিয়ে ।
আদর্শবাদী ও বাস্তববাদী বিতর্ক :-
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক শাস্ত্রটির
বিকাশে প্রথম বিতর্কটির সূত্রপাত ঘটে আদর্শবাদী ও বাস্তববাদী তাত্ত্বিকদের মধ্যে
। আদর্শবাদীদের মতে, যুদ্ধের জন্য মানুষের দ্বারা সৃষ্ট বিভিন্ন সংগঠন ও
প্রতিষ্ঠানগুলির ত্রুটি মূলত দায়ী । সেজন্য তারা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যুদ্ধ ও
নৈরাজ্যকে দূর করে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলিকে সংশোধন এবং
প্রয়োজনে নতুন প্রতিষ্ঠান গঠনের কথা বলেছেন ।
1939 খ্রিস্টাব্দে ই. এইচ. কার ( E. H. Carr ) - এর
‘টোয়েন্টি ইয়ারস ক্লাইসিস' গ্রন্থটি প্রকাশের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে
এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির আবির্ভাব ঘটে, যা বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে পরিচিত ।
তাঁর মতে, আদর্শবাদীরা যেভাবে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সমন্বয়সাধনের আশা প্রকাশ
করেন তা বাস্তবে সম্ভব নয় ।
সাবেকি ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি :-
একটি স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক শাস্ত্রটির 1960 - এর দশকে সাবেকি ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির তাত্ত্বিকদের মধ্যে দ্বিতীয় বিতর্কের সূত্রপাত হয় ।
সনাতনপন্থী বা সাবেকি পদ্ধতির তাত্ত্বিকদের
মতে, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা হল বহুবিচিত্র প্রকৃতির মানবিক সম্পর্কের দ্বারা রচিত
একটি সামাজিক জগৎ । এই জগতে শৃঙ্খলা, স্বাধীনতা, মুক্ত, ন্যায় প্রভৃতির মতো
মানবিক মূল্যবোধগুলি বিরাজ করে । আন্তর্জাতিক সম্পর্ক শাস্ত্রটি যেহেতু অন্যতম
একটি সামাজিক বিজ্ঞান, তাই এখান থেকে মূল্যবোধগুলিকে সম্পূর্ণভাবে বিসর্জন দেওয়া
সম্ভব নয় কাম্যও নয় ।
আচরণবাদীদের মতে, বৈজ্ঞানিক আলোচনায় সেই তথ্যকেই
প্রধান অবলম্বন করা হয় যা প্রত্যক্ষ, অনুধাবনযোগ্য এবং প্রমাণ সাপেক্ষ । অর্থাৎ
পছন্দ, অপছন্দ মূল্যবোধ, নৈতিকতা ইত্যাদি বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে
অপ্রয়োজনীয় তাঁরা প্রকৃতি বিজ্ঞানের মতো পদ্ধতিগত যাথার্থ্য ।
নয়া বাস্তববাদ ও নয়া-উদারনীতিবাদ :-
নয়া বাস্তববাদের আলোচনায় আন্তর্জাতিক
ব্যবস্থার কাঠামো এবং একই সঙ্গে তার একক রাষ্ট্রগুলির সম্পর্ক গুরুত্ব পেয়েছে ।
নয়া বাস্তব বাদীরা মনে করেন, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রগুলির মধ্যে ক্ষমতা
ও সামর্থ্যগত অসাম্যের কারণেই তারা নিজ নিজ স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে
প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় । আর এইভাবেই সৃষ্টি হয় আন্তর্জাতিক নৈরাজ্য ।
অপরদিকে নয়া - উদারনীতিবাদী
তাত্ত্বিকরাও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রগুলির মধ্যে বিরোধ ও প্রতিযোগিতাকে
স্বীকার করেন । কিন্তু একই সঙ্গে তাঁরা মনে করেন যে, রাষ্ট্রগুলি তাদের নিজস্ব
প্রাপ্তিকে চূড়ান্ত করতেই অপর রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সহযোগিতায় লিপ্ত হয় ।
নয়া বাস্তববাদীরা যেখানে শুধুমাত্র নিরাপত্তা ও স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়েছেন,
সেখানে নয়া-উদারনীতিবাদীরা অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জনকল্যাণ এবং আন্তর্জাতিক স্তরে
পরিপূর্ণ শান্তি প্রতিষ্ঠাকেই লক্ষ্য হিসেবে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন ।
এক্ষেত্রে রবার্ট কেওহান জোসেফ নাই প্রমুখের বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ ।
দৃষ্টবাদ এবং উত্তর দৃষ্টবাদ :-
1980 - র দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নতুন বিতর্কের উদ্ভব হয় । এই বিতর্কটিকে দৃষ্টবাদী এবং
উত্তর দৃষ্টবাদীদের মধ্যে বিতর্ক বলে অভিহিত করা হয় ।
প্রতিষ্ঠিত দৃষ্টবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে
বাস্তববাদ নয়া বাস্তববাদ, আন্তর্জাতিক সমাজ সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি এবং
আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রভৃতির দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয় দেখা যায় ।
অর্থনৈতিক উপাদানকে বাদ দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনা কখনোই সম্পূর্ণতা
লাভ করতে পারে না বলে মার্কসবাদীগণ অভিমত ব্যক্ত করেন
।
অপরদিকে, উত্তর দৃষ্টবাদী তত্ত্বগুলির মধ্যে
সমালোচনামূলক তত্ত্ব, নারীবাদী তত্ত্ব, প্রভৃতির সমন্বয় দেখা যায় । এঁদের মতে,
আমরা যাকে বাস্তব বলি সেটা আসলে একটি সামাজিক নির্মাণ এবং এই নির্মাণ
প্রকিয়ায় কোনো একটি বিশেষ বিষয়কে সত্য বলে প্রচার করা হয় ।
উপসংহার :-
উপরোক্ত আলোচনা থেকে লক্ষ করা যায় যে, আন্তর্জাতিক
সম্পর্ক শাস্ত্রটির বিবর্তন বিভিন্ন ধারায় ঘটে চলেছে । প্রথম পর্বে, কান্টীয়
আদর্শে শান্তি ও নিরাপত্তার ভাবনা গুরুত্ব পেয়েছে । দ্বিতীয় পর্বে হবসীয়
আদর্শের দ্বারা নিরাপত্তাহীনতা ও নৈরাজ্যময় পরিস্থিতির ভাবনাচিন্তা প্রাধান্য
পেয়েছে । আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নামক শাস্ত্রটি গতিশীল সমাজবিজ্ঞানের অংশ হওয়ায়
প্রতিনিয়ত এতে নানান পরিবর্তন ও সংযোজন হয়ে চলেছে । তাই এই শাস্ত্রটিকে গতিশীল
শাস্ত্র বলা যায় ।