গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য ( Distinction between Democracy and Dictatorship )

 🎭 গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য ( Distinction between Democracy and Dictatorship ) :


    গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্র হল দুটি পরস্পর-বিরোধী রাজনৈতিক আদর্শ । স্বাভাবিকভাবেই গণতান্ত্রিক ও একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মধ্যে কতকগুলি পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় । এগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল —

 ১. সার্বভৌমিকতা :-
         গণতন্ত্রে জনগণই হল সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী । তাই গণতন্ত্রকে জনমত পরিচালিত শাসনব্যবস্থা বলে অভিহিত করা হয় । কিন্তু একনায়কতন্ত্রে জনমতের কোনো মূল্যই নেই । জনগণশাসনকার্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে না ।

 ২. ব্যক্তি, না রাষ্ট্র :-
          গণতন্ত্রে জনগণের কল্যাণসাধনের জন্যই রাষ্ট্রের প্রয়োজন বলে মনে করা হয় । আধুনিক জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রগুলির দিকে তাকালেই এই বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণিত হয় । কিন্তু, একনায়কতন্ত্রে ব্যক্তির পরিবর্তে রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্বের কথা বলা হয় । এরূপ শাসনে জন্ম থেকেই ব্যক্তি রাষ্ট্রের যূপকাষ্ঠে বলিপ্রদত্ত ।

 ৩. দলব্যবস্থা :-
        গণতন্ত্রে একাধিক রাজনৈতিক দল অপরিহার্য । এরূপ শাসনব্যবস্থায় প্রতিটি রাজনৈতিক দল স্বাধীনভাবে কাজ করতে সক্ষম হয় । সরকারের ভুলত্রুটির সমালোচনা করে বিরোধী দল নিজের অনুকূলে জনমত গঠন করতে পারে । কিন্তু একনায়কতন্ত্রে একনায়কের দল ছাড়া অন্য সব দলের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয় । কারাদণ্ড, মৃত্যুদণ্ড, গুপ্তহত্যা প্রভৃতির মাধ্যমে বিরোধী নেতৃবৃন্দের কণ্ঠরোধ করে নিজের অত্যাচারী শাসনকে নিরঙ্কুশ করার ব্যবস্থা করেন ।

 ৪. স্বাধীনতা :-
        জনগণের রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতার স্বীকৃতি গণতন্ত্রের লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য । এখানে নাগরিকদের স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের অধিকার ষ, সভাসমিতি করার অধিকার, সরকারি কার্যাবলির সমালোচনা করার অধিকার প্রভৃতি স্বীকৃতিলাভ করে । কিন্তু একনায়কতন্ত্রে মানুষের সর্বপ্রকার স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা হয় ।

 ৫. বিশ্বশান্তি :-
        গণতন্ত্র বিশ্বশান্তিতে বিশ্বাসী । সর্বপ্রকার বলপ্রয়োগ গণতন্ত্রের নীতি বিরুদ্ধ । কিন্তু একনায়কতন্ত্র জাতীয়তাবাদ প্রচারের মাধ্যমে বিশ্বে অশান্তিকে আহ্বান করে । একনায়কতন্ত্রের তাত্ত্বিক নিসে প্রচার করেছিলেন যে , শান্তির পথ দুর্বলের পথ ।

 ৬. শাসনব্যবস্থার প্রকৃতি :-
             গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগন অজ্ঞ, অশিক্ষিত এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন বলে তাদের প্রতিনিধিরাও অনুরূপ চরিত্রসম্পন্ন হন । কিন্তু একনায়কতন্ত্রে সুযোগ্য ও সুদক্ষ প্রধান শাসকের একক নেতৃত্বে শাসনকার্য পরিচালিত হয় বলে এরূপ শাসনব্যবস্থাকে দেশের ভিন্নমুখী সমস্যার দ্রুত সমাধানের পক্ষে বিশেষ উপযোগী বলে অনেকে মনে করেন ।

 ৭. দলীয় শাসনের ফল :-
         গণতন্ত্র দলীয় শাসন হওয়ায় এরূপ শাসনব্যবস্থায় দলীয় সংঘর্ষ, ভোট ক্রয়বিক্রয়, নির্বাচনে অর্থের অপচয় প্রভৃতি দলীয় শাসনের কুফলগুলি দেখা যায় । কিন্তু একনায়কতন্ত্রে একটিমাত্র রাজনৈতিক দল থাকায় এরূপ শাসনব্যবস্থায় দলীয় শাসনের কুফল প্রত্যক্ষ করা যায় না ।

 ৮. সাম্য ও স্বাধীনতা :-
          সাম্য, সমানাধিকার ও ব্যক্তিস্বাধীনতার নীতিসমূহের ওপর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত । এরূপ শাসনব্যবস্থায় জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও স্ত্রীপুরুষ নির্বিশেষে সকলেই সমান । কিন্তু একনায়কতন্ত্রে এইসব গণতান্ত্রিক নীতি সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত হয় । এরূপ শাসনব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বিনা প্রতিবাদে নিজেদের স্বার্থের পরিপন্থী শাসনকেও বাধ্য হয়ে মেনে নেয় ।

 ৯. স্থায়িত্ব :-
        স্থায়িত্বের অভাব গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান ত্রুটি । কিন্তু একনায়কতন্ত্র একদলীয় শাসন হওয়ায় দলত্যাগ, রাজনৈতিক দলাদলি, পরস্পর-বিরোধী স্বার্থের দ্বন্দ্ব প্রভৃতি এখানে থাকে না । সুযোগ্য ও সুদক্ষ একনায়কের বজ্রকঠিন নেতৃত্ব এরূপ শাসনব্যবস্থার স্থায়িত্বকে নিশ্চিত করে তোলে ।

 ১০. স্বায়ত্তশাসন :-
        গণতন্ত্রে জনগণের স্বায়ত্তশাসন স্বীকৃত । কিন্তু একনায়কতন্ত্রে জনগণের এই অধিকার সম্পূর্ণভাবে অস্বীকৃত । জেমস্ মিল গণতন্ত্রকে আধুনিককালের সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কার বলে অভিহিত করেছেন ।

১১. বিপ্লবের সম্ভাবনা :-
                ‌‌ গণতন্ত্রে জনগণ ব্যালটের সাহায্যে শাস্তিপূর্ণভাবে সহজেই সরকারের পরিবর্তন ঘটাতে পারে । তাই এরূপ শাসনব্যবস্থা অনেকাংশে বিপ্লবের সম্ভাবনা মুক্ত । কিন্তু একনায়কতন্ত্রে শান্তিপূর্ণভাবে কখনোই সরকারের পরিবর্তন সম্ভব নয় । জনগণের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত অসত্তোষ একদিন বিপ্লবের আকার ধারণ করে এরূপ শাসনব্যবস্থার ধ্বংসসাধন করে ।

 ১২. উপযোগিতা :-
       গণতন্ত্র জনগণের শাসন হওয়ায় বৃহদায়তন রাষ্ট্রের পক্ষে তা বিশেষ উপযোগী । কিন্তু একনায়কতন্ত্রে জনগণের কোনো ভূমিকা নেই । তাই একজন মাত্র শাসকের পক্ষে সমগ্র দেশের শাসনকার্য সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা অসম্ভব ।
     সুতরাং বলা যায় , বৃহদায়তন রাষ্ট্রের পক্ষে একনায়কতন্ত্র অনুপযোগী ।
উপসংহার :-
   উপরিউক্ত আলোচনার ভিত্তিতে মন্তব্য করা যায় যে, একনায়কতন্ত্র অপেক্ষা গণতন্ত্র শ্রেষ্ঠ শাসনব্যবস্থা । কিন্তু উদারনৈতিক গণতন্ত্র কার্যক্ষেত্রে ধনি- বণিকশ্রেণির স্বার্থে পরিচালিত হয়ে জনস্বার্থ উপেক্ষা করে বলে সমাজতন্ত্রীদের অভিযোগ । কারণ, এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের কার্যত বিশেষ কোনো ভূমিকা থাকে না । এদিক থেকে বিচার করে কেবল সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় জনগণের প্রকৃত সার্বভৌমিকতা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে বলে তাঁরা মনে করেন ।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.