বামাবোধিনী পত্রিকা, হিন্দু প্যাট্রিয়ট, হুতোম পাচার নকশা, নীল দর্পণ, গ্রামবার্তা প্রকাশিকা

উনিশ শতকের বাংলায় উল্বালেখযোগ্য বিভিন্ন পত্রিকা
( Notable magazines in nineteenth century Bengal )


 সূচনা :-
     বাংলা সাময়িক পত্রপত্রিকা সংবাদপত্র এবং সাহিত্য রচনার মধ্য দিয়ে তাঁরা তৎকালীন সমাজকে বাংলার আপামর জনসাধারণের সামনে তুলে ধরেন । ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করার কাজেও তাঁরা ঝাপিয়ে পড়েন । নীলচাষিদের দুঃখ - দুর্দশার কাহিনি , অত্যাচারী নীলকরদের প্রকৃত স্বরূপ, সতীদাহ প্রথা রদ এবং বিধবা বিবাহ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে বাঙালির মনোভাব , — ঊনিশ শতকের সমাজ জীবনের এমন সব বিচিত্র ছবির কোলাজে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল সাময়িকপত্র, সংবাদপত্র এবং সাহিত্যের পাতায় । আক্ষরিক অর্থেই এরা হয়ে উঠেছিল তৎকালীন সমাজজীবনের আয়না । এই প্রসঙ্গে রামনারায়ণ তর্করত্নের - ‘কুলীনকুল সর্বস্ব’ (১৮৫৪ খ্রি.), মাইকেল মধুসূদন দত্তের - 'একেই কি বলে সভ্যতা' (১৮৬০ খ্রি.),  ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ' (১৮৬০ খ্রি.) প্রভৃতি নাটক, প্রভৃতি আখ্যান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ।

বামাবোধিনী পত্রিকা :-
          উনিশ শতকে বাংলার সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল নারী শিক্ষা ও নারীমুক্তি আন্দোলন । এই আন্দোলনের সমর্থনে উনিশ শতকে বেশ কিছু সাময়িকপত্র প্রকাশিত হয় । এর মধ্যে ব্রামাবোধিনী ' পত্রিকার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । ব্রাহ্ম সমাজ সংস্কারের ফসল হিসাবে এই পত্রিকার জন্ম হয় ।

 উদ্যোগ :-
      সংসার বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা জনমত গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল । রক্ষণশীল সমাজের বুকে দাঁড়িয়ে এই পত্রিকা নারীর অধিকার ও নারী শিক্ষা সম্পর্কে স-রব হয়ে ওঠে । প্রথম থেকে এতে ইতিহাস , ভূগোল , বিজ্ঞান , গৃহ - চিকিৎসা , শিশুপালন ছাড়াও মনোরঞ্জক প্রবন্ধাদিও প্রকাশিত হত । নারীদের সাহিত্যরচনার জন্য উৎসাহিত করা এবং পুরস্কৃত করার  ব্যবস্থাও ছিল । এই পত্রিকার শিরোদেশে লেখা থাকত 'কন্যাপ্যেবং' পালনীয়া শিক্ষনীয়াতিযুক্ততঃ অর্থাৎ, ( কন্যাকে পালন করিবেন ও যত্নের সহিত শিক্ষা দিবেন ) ।

 বিশিষ্ট লেখিকা :-
        মানকুমারী বসু ছিলেন এই পত্রিকার বিশিষ্ট লেখিকা । তার রচিত ‘বিগত শতবর্ষে ভারত - রমণীদের অবস্থা' – প্রবন্ধটি তৎকালীন সমাজে ভারতীয় নারী জীবনের অসহনীয় দুরবস্থার কথা বর্ণনা করেছিল ।



হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা :-
             উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে জাতীয়তাবাদী জনমত জাগ্রত করা, জনগণকে প্রশিক্ষণ দেওয়া, তাদের সমবেত ও সংহত করার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান হাতিয়ার ছিল সংবাদপত্রগুলি । পত্রিকাগুলি ছিল পরাধীন ভারতবর্ষে দেশ-প্রেম ও জাতীয়তাবাদী আদর্শ  প্রচারের অন্যতম মাধ্যম ।

 সাঁওতাল বিদ্রোহ :-

          সাঁওতাল বিদ্রোহ সম্পর্কে শিক্ষিত হিন্দু বাঙালি নীরব থাকলেও হিন্দু প্যাট্রিয়ট  ইংরেজদের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে মুখর হয়ে ওঠে । সাঁওতালদের থেকে অরণ্যের অধিকার কেড়েনেওয়া, তাদের বেগার খাটানো ইত্যাদি অর্থনৈতিক শোষণের চিত্র এই পত্রিকার পাতায় তুলে ধরা হয় । এই পত্রিকাটির উল্লেখযোগ্য কীর্তি হল নীলবিদ্রোহের সময় নীলকরদের স্বরূপ উদ্ঘাটন এবং তৎকালীন সমাজকে ইংরেজদের অপশাসন সম্পর্কে সচেতন করে তোলা ।

 বিশিষ্ট লেখক :-
        এই পত্রিকার সম্পাদক লেখেন — বাংলার নীলচাষ একটি সংগঠিত জুয়াচুরি ও নিপীড়ন ব্যবস্থামাত্র । হিন্দু প্যাট্রিয়টের আন্তরিক প্রচেষ্টাতেই নীল বিদ্রোহের খবর বাংলার শিক্ষিত জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে । নীলকুঠির মালিকরা হরিশচন্দ্রের লেখনীতে ক্রুদ্ধ হয়ে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করে । তবু পত্রিকার কণ্ঠ রোধ করা যায়নি ।
       হরিশচন্দ্রের মৃত্যুর পর কৃষ্নদাস পাল এই পত্রিকার সম্পাদক হন । আমৃত্যু তিনি সরকারের বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে সরব ছিলেন ।



হুতোম পাচার নকশা :-
            ঔপনিবেশিক সমাজে দেশীয় বিত্তবান শ্রেণির বিলাসব্যসন, কপটতা, ধর্মের নামে ভণ্ডামির ছবি সমকালীন সাহিত্যে জীবন্ত রূপ লাভ করে । এক্ষেত্রে যে সকল গ্রন্থ সমাজে আলোড়ন তুলেছিল তার মধ্যে কালীপ্রসন্ন সিংহের - 'হুতোম প্যাচার নকশা'

হুতোম পাঁচার নকশা ' গ্রন্থটিতে ব্যঙ্গবিদ্রুপের মাধ্যমে কলকাতার বিত্তবান শ্রেণির স্বার্থপরতার
কথা তুলে ধরা হয়েছে । এমনই এক চরিত্রের নাম বাগাম্বর মিত্র । লেখার মাধ্যমে কলকাতার এই ধনী - মধ্যবিত্ত শ্রেণির উৎসবপ্রিয়তা, বিলাসব্যসনের চিত্র নিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে । 

বাবু সম্প্রদায় সৃষ্ট্রি :-
          চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অনুকরণে ' বাবু ' সম্প্রদায় তৈরি হয়েছিল লেখক তাদের জীবনযাপনের প্রতি তীব্র ব্যঙ্গের কশাঘাত হেনেছেন ঊনিশ শতকের শিক্ষিত যুবক, ঘোর ব্রাহ্ম, জুতোপায়ে নবীন নাগর কলকাতার বিচিত্র মানুষের নানা অসঙ্গতির কথা লেখক আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন ।




 নীল দর্পণ :-
      নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে নীলকর সাহেবদের অত্যাচার ও নীল বিদ্রোহের
নীল দর্পণ প্রচ্ছদ ও দীনবন্ধু মিত্র

পটভূমিতে 'নীল দর্পণ' নাটকটি রচনা করেছিলেন নীলকরদের নির্মম অত্যাচারে গোলক বসুর সম্পন্ন নিরীহ পরিবার এবং সাধুচরণ নামে এক বিশিষ্ট ভদ্র রায়তের বংশ ধ্বংসের করুণ কাহিনিকে অবলম্বন করেই ‘নীল দর্পণ' নাটকটি রচিত হয়েছে ।

           এ নাটকের কাহিনি ছিল তৎকালীন গ্রাম - বাংলার বাস্তব প্রতিচ্ছবি । নাটকে নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের স্বরূপ তুলে ধরে দীনবন্ধু মিত্র তৎকালীন সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন ।



গ্রামবার্তা প্রকাশিকা :-
          ঊনবিংশ শতকের অধিকাংশ পত্রপত্রিকাই কলকাতা শহর থেকে প্রকাশিত হত । কিন্তু 'গ্রামবার্তা প্রকাশিকা' ছিল একটি ব্যতিক্রমী পত্রিকা । শহর থেকে অনেক দূরে বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি গ্রাম থেকে এটি প্রকাশিত হত । কাঙাল হরিনাথ ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে এই পত্রিকা প্রকাশ করেন ।

 প্রেক্ষাপট :-
        এই পত্রিকায় গ্রামীণ জীবনে শোষণের ভয়াবহ রূপ পরিবেশিত হত । নীলকর সাহেবদের নির্মম অত্যাচার থেকে জমিদার মহাজনদের নির্লজ্জ আর্থিক শোষণের কাহিনি — সমস্ত কিছুই এই পত্রিকায় তীব্রভাবে সমালোচিত হয় । পাবনা বিদ্রোহের সময় কলকাতার ‘সোমপ্রকাশ‘ ও 'অমৃতবাজারের’ মতো বিখ্যাত পত্রিকা প্রজাদের সমর্থন জানায়নি । কিন্তু 'গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ নিরবচ্ছিন্নভাবে জমিদারদের নির্মম অত্যাচারের স্বরূপ প্রকাশ করতে থাকে । গ্রামীণ সমাজ ও জীবনের বাস্তব চিত্র তুলে ধরে এই পত্রিকা তৎকালীন শহুরে পত্রিকার মাঝে নিজের এক ব্যতিক্রমী, স্বতন্ত্র জায়গা তৈরি করে নিয়েছিল ।


Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.