গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি ( Arguments for and against democratic governance ) :
ভূমিকা :-
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রকৃতি , উদ্দেশ্য ও
কার্যাবলিকে কেন্দ্র করে বহু রাষ্ট্রনীতিবিদদের মধ্যে মতবিরোধ আছে । এরূপ
শাসনব্যবস্থার সপক্ষে ও বিপক্ষে বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন যুক্তি - তর্কের অবতারণা
করা সত্ত্বেও গণতন্ত্র গ্রহণীয় অথবা বর্জনীয় — সে সম্পর্কে কোনো স্থির সিদ্ধান্তে
উপনীত হওয়া রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের পক্ষে অদ্যাবধি সম্ভব হয়নি ।
জন স্টুয়ার্ট মিল, বেন্থাম, টক্ভিল, স্পেন্সার , ল্যাস্কি
, বার্কার , ব্রাইস প্রমুখ রাষ্ট্রনীতিবিদ গণতন্ত্রকে সর্বশ্রেষ্ঠ শাসন বলে
প্রমাণ করার জন্য নানা যুক্তি প্রদর্শন করেছেন ।
অপরদিকে , লেকি, কার্লাইল, ফ্যাগুয়ে, নিসে, ট্রিটকে, হেনরি
মেইন প্রমুখ ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে গণতন্ত্রকে চরমভাবে সমালোচনা করে এই
শাসনব্যবস্থার অসারতা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন ।
সপক্ষে যুক্তি ( Arguments For )
গণতন্ত্রের সপক্ষে সাধারণত নিম্নলিখিত যুক্তিগুলি প্রদর্শন করা হয় :
১. গণ - সার্বভৌমিকতার বাস্তবায়ন :-
গণতন্ত্রে জনগণই শেষ কথা বলার অধিকারী ।
কোন্ দল সরকার গঠন করবে , জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সরকারের নীতি কী হবে ,
দুর্নীতিপরায়ণ কিংবা অপদার্থ অথবা জনস্বার্থ - বিরোধী দলকে ক্ষমতাচ্যুত করা
প্রভৃতি ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা জনসাধারণের হাতে কেবল গণতন্ত্রই
প্রদান করে বলে দাবি করা হয় ।
২. অইনের শাসন প্রতিষ্ঠা :-
কেউ কেউ গণতন্ত্রের পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন
করতে গিয়ে এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে , কেবল গণতন্ত্রেই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে
পারে । এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে ফাইনার বলেছেন , গণতন্ত্রে যথাবিহিত আইন
পদ্ধতি ( due process of law ) ছাড়া আমাদের ব্যক্তি - জীবনের ওপর হস্তক্ষেপ করা
সম্ভব নয় ।
৩. মানুষের মর্যাদা :-
গণতন্ত্র মানুষের
মর্যাদা রক্ষার সহায়ক বলেও অনেক সময় দাবি করা হয় । কিন্তু গণতন্ত্রে জনসাধারণই
সর্বপ্রকার ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় তারা প্রত্যেকেই মর্যাদার সু - উচ্চ
আসনে অধিষ্ঠিত থাকে ।
৪. স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ :-
গণতন্ত্রে স্বাধীন ও
নিরপেক্ষ বিচার বিভাগের অবস্থিতি এর সাফল্যকে ত্বরান্বিত করে ।এরুপ শাসনব্যস্থায়
আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত থেকে বিচার বিভাগ কার্য সম্পাদন করতে
পারে বলে তার পক্ষে সংবিধানের পবিত্রতা রক্ষা করা কিংবা নাগরিকদের অধিকার রক্ষায়
অগ্রণী ভূমিকা পালন করা সম্ভব হয় ।
৫. সাম্য , মৈত্রী ও স্বাধীনতার অনুপন্থী :-
সাম্য , মৈত্রী ও স্বাধীনতা ' —
এই তিনটি আদর্শের ওপর ভিত্তি করে গণতন্ত্রের ইমারত দাঁড়িয়ে থাকে । জাতি , ধর্ম
, বর্ণ , ধনী - নির্ধন , স্ত্রী - পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই আইনের চোখে সমান এবং
সকলেই আইন কর্তৃক সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার সুযোগ পায় বলে প্রত্যেকে নিজ নিজ
ব্যক্তিসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটতে পারে ।
৬. সর্বাধিক জনকল্যাণ সাধন :-
বেথাম ( Bentham ) এর মতে , শাসক ও
শাসিতের স্বার্থের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করে সর্বাধিক জনগণের সর্বাধিক মঙ্গল
সাধনের সমস্যাই হল সুশাসনের প্রধান সমস্যা । শাসিতকে শাসকের পদে উন্নীত করা সম্ভব
হলে এই সমস্যার সমাধান করা সহজ হয় । একমাত্র গণতন্ত্রেই শাসিত শাসকের পদে
অধিষ্ঠিত হতে পারে ।
তাই জেমস্ মিল ( James Mill ) গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে '
আধুনিককালের সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কার ' বলে অভিহিত করেছেন ।
৭. ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠা :-
বার্কারের মতে, গণতন্ত্রে
ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠা সম্ভব । রাজনৈতিক সত্যের উপলব্ধির জন্য পারস্পরিক
আলাপ-আলোচনা এবং ভাব-বিনিমযয়ের প্রয়োজন । একমাত্র গণতন্ত্রেই তা সম্ভব ।
৮. রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি :-
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায়
ধনী-দরিদ্র, অভিজাত-অভাজন, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক এবং
সুস্থ বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শাসনকার্য পরিচালনায়
অংশগ্রহণ করতে পারে । তাদের রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানসিক ও
চারিত্রিক উন্নতি সাধিত হয় ।
৯. স্থায়িত্ব :-
অনেকের মতে, স্থায়িত্ব হল গণতন্ত্রের অন্যতম উল্লেখযোগ্য
গুণ । জনগণের সম্মতির ওপর এরূপ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত বলে সরকারের প্রতি জনগণ
অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদর্শন করে । ফলে এরূপ শাসনব্যবস্থা যথেষ্ট পরিমাণে
স্থায়িত্ব লাভ করতে সক্ষম হয় ।
১০.বিপ্লবের সম্ভাবনা কম :-
জনগণের হাতে সরকার পরিবর্তনের ক্ষমতা থাকায়
কোনো গণতান্ত্রিক সরকার জনস্বার্থ-বিরোধী কাজ করতে থাকলে জনগণ অতি সহজেই
নির্বাচনের সময় সেই সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত ক'রে নিজেদের পছন্দমতো সরকার গঠন করতে
পারে । তাই জনগণের অসন্তোষ পুঞ্জীভূত হয়ে রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের আকার ধারণ করতে
পারে না । এইভাবে ব্যালটের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে সরকারের পরিবর্তন সম্ভব
হওয়ায় অনেকে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে কাম্য বলে মনে করেন ।
বিপক্ষে যুক্তি ( Arguments Against )
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পক্ষে নানা প্রকার যুক্তির অবতারণা করা হলেও
বিরুদ্ধবাদীরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সমালোচনা করেন ।
১. অক্ষম ও অশিক্ষিতের শাসন : -
যে - কোনো শাসনব্যবস্থার সাফল্য নির্ভর করে
শাসকবর্গের যোগ্যতা, দক্ষতা, দূরদৃষ্টি এবং বুদ্ধিমত্তার ওপর । গণতান্ত্রিক
শাসনব্যবস্থায় সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হয় । কিন্তু জনগণের
সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ সাধারণত অজ্ঞ, অশিক্ষিত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয় বলে তাদের
নির্বাচিত প্রতিনিধিবর্গও অনুরূপ চরিত্রের হয় । ফলে এরূপ শাসনব্যবস্থা কার্যত
অক্ষম ও অশিক্ষিতের শাসনে পর্যবসিত হয় ।
২. নৈতিক অবনতি :-
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণ অজ্ঞ
ও অশিক্ষিত হয় বলে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক জ্ঞানের অভাব বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয় ।
জনগণের অজ্ঞতার সুযোগে কতিপয় স্বার্থপর অথচ চতুর এবং বাক্পটু নেতা তাদের
বিভ্রান্ত করে শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন । তাছাড়া, জনগণের রাজনৈতিক জ্ঞানের অভাব
থাকায় নির্বাচনের সময় উৎকোচ গ্রহন, নির্বাচনে কারচুপি প্রভৃতি নীতিবিগর্হিত
ক্রিয়াকলাপ অনুষ্ঠিত হয় ।
৩. সৎ ও যোগ্য ব্যক্তির স্থান নেই :-
অনেকের মতে , গণতন্ত্রে সৎ ও যোগ্য
ব্যক্তিদের স্থান নেই । এরূপ শাসনব্যবস্থায় দলীয় রাজনীতির প্রাধান্য থাকায় সৎ
এবং যোগ্য অথচ রাজনীতি - বিমুখ ব্যক্তিরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সম্মত
হন না ।
৪. শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান প্রভৃতির বিরোধী :-
হেনরি মেইন, লেব প্রমুখ গণতন্ত্রকে
শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, চারুকলা প্রভৃতির বিরোধী বলে সমালোচনা করেন । তাঁদের
মতে, সাধারণ মানুষ অজ্ঞ ও অশিক্ষিত বলে শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, চারুকলা
প্রভৃতির গুরুত্ব যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পারে না । তাই এগুলির বিকাশ সাধনে তারা
সচেষ্ট হয় না । লেবঁর মতে , “ সভ্যতার অগ্রগতির পক্ষে এটা খুবই সৌভাগ্যের বিষয়
যে, বিজ্ঞান ও শিল্পের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ আবিষ্কারগুলি হওয়ার পর জনসাধারণ
রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে ।
৫. স্থায়িত্বের অভাব :-
হেনরি মেইনের মতে, স্থায়িত্বের অভাব গণতন্ত্রের
অন্যতম প্রধান ত্রুটি । অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে যে, জনগণ কর্তৃক পরিচালিত
শাসনব্যবস্থায় পরস্পর - বিরোধী স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকার ফলে শাসনকার্য
যথাযথভাবে পরিচালনা করা সরকারের পক্ষে সম্ভব হয় না ।
৬. দলীয় শাসনের কুফল :-
দলপ্রথা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অপরিহার্য
অঙ্গ কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলির রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের দ্বন্দ্ব অনেক সময় সংঘর্ষে
রূপান্তরিত হয়ে দেশের শান্তি - শৃঙ্খলা বিনষ্ট করে । তাছাড়া, সরকারি দল পুনরায়
ক্ষমতালাভের জন্য সরকারি প্রশাসন এবং অর্থকে কাজে লাগায় ।
৭. ব্যয়বহুল :-
অনেকে গণতন্ত্রকে ব্যয়বহুল শাসনব্যবস্থা বলে সমালোচনা করেন
জনমত গঠন , নির্বাচন অনুষ্ঠান , প্রচারকার্য প্রভৃতির পেছনে গণতন্ত্রে যে - বিপুল
পরিমাণ অর্থের অপচয় হয় , অন্য কোনো শাসনব্যবস্থায় তা হয় না ।
৮. আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য বৃদ্ধি :-
ক্ষমতাসীন হয়ে অধিকাংশ সময়
গণদেবতাকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য ব্যস্ত থাকার ফলে তাঁরা শাসনকার্যে মনোনিবেশ করতে
পারেন না । স্বাভাবিকভাবেই আমলাদের ওপর তাদের অত্যধিক পরিমাণে নির্ভর করতে হয় ।
কিন্তু আমলাদের প্রাধান্য বৃদ্ধির অর্থই হল দীর্ঘসূত্রতা এবং জনস্বার্থ উপেক্ষিত
হওয়া ।
৯. রক্ষণশীল শাসনব্যবস্থা :-
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা অজ্ঞ ও অশিক্ষিতের
শাসন বলে জন প্রতিনিধিরা গতানুগতিকতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন না । নতুন নতুন
চিন্তাভাবনা, ধ্যানধারণা, আবিষ্কার প্রভৃতিকে জনগণ এবং তাদের প্রতিনিধিরা সাদরে
গ্রহণ করতে পারেন না । ফলে এরূপ শাসনব্যবস্থা কার্যত প্রগতি - বিরোধী চরম
রক্ষণশীল শাসনব্যবস্থায় পরিণত হয় ।
উপসংহার :- গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে যেসব যুক্তির অবতারণা করা হয়, তাদের অনেকগুলিকে ভিত্তিহীন এবং কষ্টকল্পনা-প্রসূত বলে মনে করা হয় । লর্ড ব্রাইসের মতে, গণতন্ত্র হয়তো বিশ্বমানবের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করতে পারেনি, হয়তো । বার্নস-ও অনুরূপভাবে মন্তব্য করেছেন যে, প্রচলিত প্রতিনিধিত্বমূলক আইনসভাগুলি ত্রুটিযুক্ত — একথা কেউ অস্বীকার করে না । বস্তুত, গণতন্ত্রের ত্রুটিবিচ্যুতিগুলি বিদূরিত করে তাকে যুগোপযোগী করে নেওয়াই সংগত । দলপ্রথার কুফল দূরীকরণ, শিক্ষার সম্প্রসারণ, সংখ্যালঘুর স্বার্থ সংরক্ষণ, সর্বোপরি অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই গণতন্ত্র যে সর্বোৎকৃষ্ট শাসনব্যবস্থায় পরিণত হবে, এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই । |