রামমোহন রায় একবার তাঁর বন্ধুকে লিখেছিলেন, আমি মনে করি ভারতীয়দের
রাজনৈতিক ও সামাজিক সুবিধার জন্য তাদের ধর্মের কিছু পরিবর্তন ঘটানো একান্ত
প্রয়োজন । ঊনিশ শতকের ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের মূল বৈশিষ্ট্য হল হিন্দুধর্মের
পৌত্তলিকতা, আচার সর্বস্বতা, ধর্মীয় ভেদাভেদে আঘাত হেনে মানবধর্মের প্রতিষ্ঠা ।
সর্বধর্মের সমন্বিত রূপ হিসাবে একেশ্বরবাদকে তুলে ধরা ।
ঃ ব্রহ্ম আন্দোলন – বিবর্তন, বৈশিষ্ট
ও পর্যালোচনা ঃ
ব্রহ্ম আন্দোলনের সূচনা ঃ
হিন্দুধর্মের সংস্কারসাধনে রামমোহন রায় যে আন্দোলনের সূচনা
করেন তা থেকেই ব্রাহ্ম সমাজের উৎপত্তি হয় । একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী রামমোহন তাঁর
ধর্মচেতনার প্রসার ঘটাতে ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে "আত্মীয় সভা" এবং পরবর্তীকালে ১৮২৮
খ্রিস্টাব্দে "ব্রাহ্মসভা" স্থাপন করেন । ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মসভার নামকরণ
হয় ব্রাহ্ম সমাজ ।
ধর্মীয় সংস্কার থেকে সামাজিক সংস্কারে বিবর্তন :
ব্রাহ্ম আন্দোলনের প্রসার –
কেশবচন্দ্র সেন |
কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে ব্রাহ্ম আন্দোলনের গতি ত্বরান্বিত হয়
। তিনি ব্রহ্ম আন্দোলনকে সামাজিক আদর্শ ও ধর্মবিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত সেন ব্রাহ্ম সমাজের আচার্য পদে অধিষ্ঠিত হন ।
বৈশিষ্ট্য :-
এই সময়কার ব্রাহ্ম আন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল – নিছক ধর্ম
আন্দোলনের গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ না রেখে একে সমাজ সংস্কার আন্দোলনের প্রতিষ্ঠানে
পরিণত করা । কেশবচন্দ্রের নেতৃত্বে বাল্য বিবাহ , বহু বিবাহ , জাতিভেদ প্রথা
প্রভৃতির বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত হয় । নারীশিক্ষা প্রসার , অসবর্ণ বিবাহ ,
বিধবা বিবাহ , শ্রমিক কল্যাণ প্রভৃতি প্রগতিশীল সংস্কারমূলক কার্যকলাপ শুরু হয় ।
এই সময় ব্রাহ্ম আন্দোলনকে বাংলার বাইরে প্রসারিত করা হয় । ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে
সবসমেত ৫৪ টি স্থানে ব্রাহ্ম সমাজের শাখা গড়ে ওঠে ।
গুরুত্ব :-
কেশবচন্দ্রের নেতৃত্বে ব্রাহ্ম আন্দোলন এক সর্বভারতীয় রূপ
নেয় । ব্রাহ্ম আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নানা শাখা সংগঠন ও পত্রপত্রিকা গড়ে ওঠে,
যেমন ব্রাহবন্ধু সভা (১৮৬০ খ্রি.), সঙ্গত সভা (১৮৬০ খ্রি.), বামাবোধিনী (১৮৬৩
খ্রি.), ইন্ডিয়ান মিরর (১৮৬১ খ্রি.), ধর্মতত্ত্ব ( ১৮৬৪ খ্রি.) প্রভৃতি । এই সকল
পত্রপত্রিকা ও সভার মধ্য দিয়ে ব্রাহ্ম আন্দোলনের আদর্শকে তুলে ধরা হয় ।
📌 ব্রাহ্ম আন্দোলনে বিভাজনের কারণ :-
সমাজ সংস্কারের প্রতি কেশবচন্দ্র ও তার অনুগামীদের আগ্রহ
প্রাচীনপন্থী ব্রাহ্মনদের মনে অসন্তোষ সৃষ্টি করে । এছাড়াও তরুণ ব্রাহ্মরা
উপবীত ( পৈতে ) ধারণে বিশ্বাসী ছিলেন না ।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর |
তাঁরা ব্রাহ্ম সমাজের অনুষ্ঠানে মহিলাদের যোগদানের
পক্ষপাতী, অসবর্ণ বিবাহের প্রতি তাদের সমর্থন ছিল । এইসব কারণে দেবেন্দ্রনাথ ও
তাঁর অনুগামীদের সাথে কেশবচন্দ্রের মতবিরোধ দেখা দেয় । ১৮৬৬ - তে কেশবচন্দ্র ও
তাঁর অনুগামীরা ‘ ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম সমাজ ’ গঠন করেন ।
🔥 বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব :-
ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম সমাজে
ব্রাহ্মধর্মকে সর্বজনীন হিসাবে তুলে ধরা হয় । জাতি - ধর্ম নির্বিশেষে অবাধ
প্রবেশাধিকার দেওয়া হয় । জনকল্যাণ, সমাজ সংস্কার ও জনগণের নৈতিক উন্নতিসাধন এই
প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য ছিল । নারীশিক্ষা উন্নয়নে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে
ভিক্টোরিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় । ভারতীয় ব্রাহ্ম সমাজের সমাজ সংস্কারমূলক
কর্মকাণ্ডের জেরে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে সরকার ‘তিন আইন' পাস করে ।
এই আইনে বাল্য বিবাহ ও বহু বিবাহকে নিষিদ্ধ করা হয় এবং বিধবা বিবাহ ও অসবর্ণ
বিবাহ আইনসিদ্ধ হয় ।
🛠ব্রাহ্ম সমাজে আবার ভাঙন :-
কেশবচন্দ্রের মনে ক্রমশ আধ্যাত্মিক
ভক্তিভাবের আধিক্য ঘটে । তিনি গুরুবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন । এই সময় বিক্ষুব্ধ
প্রগতিশীল তরুণ আনন্দমোহন বসু, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়, বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী
প্রমুখরা ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন
‘সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ'
এবং
বিজয়কৃয় গোস্বামী |
বিজয়কৃয় গোস্বামীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ।
'সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ' নির্মাণের ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন । নানাবিধ প্রগতিশীল
সামাজিক সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে তিনি সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ কে জনপ্রিয়
করে তোলেন ।
অন্যদিকে, কেশবচন্দ্র পরিচালিত ব্রাহ্ম সমাজ
‘নববিধান' নামে পরিচিত হয় । যথা –
ব্রাহ্ম সমাজ, আদি ব্রাহ্ম সমাজ, নববিধান ও সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ । সাধারণ
ব্রাহ্ম সমাজ তার নানাবিধ সমাজ সংস্কারমূলক কাজকর্মের জন্য জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল
। কিন্তু অভ্যন্তরীণ বিভেদের ফলে ব্রাহ্ম সমাজের শক্তি ক্রমশ শিথিল হয়ে পড়ে ।
এছাড়া হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবনের ফলে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে
ব্রাহ্ম আন্দোলনের আকর্ষণ কমতে থাকে ।
🎯 সর্বশেষে বলা যায় যে — ব্রাষ্ম আন্দোলন নিছক ধর্ম আন্দোলন ছিল না । সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে
ব্রাহ্ম আন্দোলনের ভূমিকা ছিল প্রগতিশীলতার প্রতীক ।
ব্রাহ্ম আন্দোলন ভারতের সনাতন ভাবধারার সঙ্গে পাশ্চাত্য ভাবধারার সমন্বয়সাধন
করে খ্রিস্টধর্মের প্রভাব থেকে ভারতের সমাজ ও সংস্কৃতিকে মুক্ত রাখতে পেরেছিল
।