চুয়াড় বিদ্রোহ ( ১৭৯৮ - ১৭৯৯ ) ঃ
কারণ :-
দেওয়ানি লাভের পর ইংরেজদের প্রধান লক্ষ্য ছিল সর্বাধিক রাজস্ব
আদায় করে কোশাগার ভরতি করা । এই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য ইংরেজরা জঙ্গলমহলে জমির
নতুন বন্দোবস্তের মাধ্যমে জমিদারদের সঙ্গে স্থায়ী ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার প্রবর্তন
করে । জমিদাররা এই অঞ্চলের প্রজাদের ওপর উচ্চহারে রাজস্ব ধার্য করেছিল ।
মেদিনীপুরের তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট রেভিনিউ বোর্ডের কাছে
লিখিত একখানি পত্রে স্বীকার করেছিলেন যে , চুয়াড়দের জমি থেকে উচ্ছেদ এবং
রাজস্বের উচ্চহাব হল চুয়াড় বিদ্রোহের প্রধান কারণ ।
বিদ্রোহ দমন :-
সরকার প্রায় দুবছর ধরে সেনা অভিযান
চালিয়ে এই বিদ্রোহ দমন করে । বিদ্রোহ দমনে ইংরেজ সরকার ভেদনীতির আশ্রয় নিয়েছিল
। পাইকদের দেয় রাজস্বের হার অনেক কমিয়েও দেওয়া হয় । সরকারের তরফ থেকে
প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় যে, পাইকদের জমি খাস দখল করা যাবে না । জমিদারদের রাজস্ব
বাকি থাকলেও তার জমি নিলাম করা যাবে না ।
বৈশিষ্ট্য :-
চুয়াড় বিদ্রোহ ছিল প্রথম উল্লেখযোগ্য আদিবাসী - কৃষক বিদ্রোহ, মেদিনীপুর,
বাঁকুড়া জেলার অন্তত জঙ্গলমহলের আদিবাসীরা এই বিদ্রোহ সংগঠিত করে । এই বিদ্রোহের
দুটি পর্যায় পরিলক্ষিত হয় । প্রথমপর্বে ( ১৭৬৬-১৭৭৬ ) জমিদারদের
নেতৃত্বে চুয়াড়রা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল ।
দ্বিতীয় পর্বে ( ১৭৯৮-১৭৯৯ ) চুয়াড়দের মধ্যে থেকেই উঠে এসেছিল
বিদ্রোহের নেতারা ।
এই বিদ্রোহের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এখানে
জমিদাররা কৃষকদের প্রতিপক্ষ না হয়ে অনেক ক্ষেত্রেই তাদের সাহায্যকারী হয়ে ওঠে ।
এই বিদ্রোহের মূল শক্তি ছিল কৃষক ।
গুরুত্ব :-
আদিবাসী ছাড়াও
বহু সাধারণ কৃষক এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিল । কোম্পানির শাসনের প্রথম দিকে
জঙ্গলমহলের আদিবাসীদের এই বিদ্রোহ ছিল পরবর্তীকালে সংগঠিত কৃষক বিদ্রোহের
অনুপ্রেরণা স্বরূপ ।
কোল বিদ্রোহ ( ১৮৩১-১৮৩২ ) ঃ
কারণ :-
কোল জনগোষ্ঠীর মানুষরা ছোটোনাগপুর সহ প্রভৃতি অঞ্চলে
স্বতন্ত্র স্বাধীন জীবনযাপন করত । ইংরেজদের নতুন জমি বণ্টন ব্যবস্থা , রাজস্বনীতি
ও বিচারপদ্ধতি আদিম কোল জনজাতির মনে ক্ষোভ সৃষ্টি করে । ইংরেজরা সিংভূম দখল করলে
স্বাধীনচেতা কোলদের মধ্যে দারুণ প্রতিক্রিয়ার সঞ্চার হয় । এরই ফলশ্রুতি হিসাবে
১৮৩১-১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে কোলরা বিদ্রোহ করে ।
বুদ্ধ ভগৎ, জোয়া ভগৎ, বিন্দ রাই, মানকি সইমুণ্ডা প্রমুখ নেতার নেতৃত্বে
কোলরা সংগঠিত হয় ।
বৈশিষ্ট্য :-
কোলদের বিদ্রোহ ছিল আদিবাসী নয় এমন জমিদার, মহাজন এবং
বিদেশি দিকুদের বিরুদ্ধে । ইংরেজ শাসনের সঙ্গে যুক্ত পুলিশ, দারোগা, ইংরেজ
কর্মচারীরাও বিদ্রোহীদের আক্রমণের সঙ্গে ছিল । এই বিদ্রোহের অন্যতম বৈশিষ্ট্য
হল বিদ্রোহীরা সীমাহীন নিষ্ঠুরতার আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন । একমাত্র কুমোর ও
ছুতোররাই অস্ত্রশাস্ত্র এবং প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ করত বলে বিদ্রোহীরা তাদের
ক্ষতি করেনি । মাসাধিককাল ধরে কোলরা এক বিশাল ভূখণ্ডের ওপর তাদের আধিপত্য বজায়
রাখে এবং ইংরেজ সরকারকে অস্বীকার করে নিজেদের সরকার প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত
নেয় । সরকারি রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে জনগণ কোলদের এই বিদ্রোহ সমর্থন করেছিল
।
বিদ্রোহ দমন :-
তিনশো বিদ্রোহীর কোল অভ্যুত্থান দমন করতে ইংরেজদের
দু'হাজার সশস্ত্র সেনা নিয়োগ করতে হয় । ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে ক্যাপটেন
উইলকিনসনের নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনী পাঁচ হাজার বর্গ মাইলের বিদ্রোহী উপজাতি
অভ্যুত্থান নির্মম অত্যাচার চালিয়ে দমন করে ।
গুরুত্ব :-
কোল বিদ্রোহকে আপাত ব্যর্থ মনে হলেও এই ঐক্যবদ্ধ
অভ্যুত্থান ইংরেজদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছিল । তারা বোঝে যে ভারতের এই
তথাকথিত অনুন্নত , অশিক্ষিত আদিম সম্প্রদায় নিজেদের স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র
কোনো মূল্যেই হারাতে রাজি ছিল না । সেখানে কোম্পানির কোনোরূপ নিয়মবিধি কার্যকর
হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় ।