ইউরোপের নগরগুলির গড়ে ওঠার বৈশিষ্ট্য || কোপারনিকাসের জ্যোতির্বিজ্ঞান

 1.  ইউরোপের নগরগুলির গড়ে ওঠার বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো ।
 👉 


 ইউরোপের নগরগুলির বৈশিষ্ট্য :-

        মধ্যযুগে , বিশেষত খ্রিস্টীয় একাদশ থেকে চতুর্দশ শতকের মধ্যে ইউরোপে নগরের যথেষ্ট প্রসার ঘটে । নগরগুলিতে প্রচুর মানুষের বসবাস শুরু হয় । মধ্যযুগীয় এসব নগরের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায় । 

1. গঠন প্রণালী :-  চোর , ডাকাত , সামন্তপ্রভুর আক্রমণ , বহিরাগত আক্রমণ প্রভৃতি প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে মধ্যযুগের ইউরোপের শহরগুলি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা থাকত । প্রাচীরের দেওয়ালের ভেতরের দিকে থাকত একাধিক তলবিশিষ্ট ঘর ও দুর্গ । এই দুর্গগুলি থেকে বহিরাক্রমণ প্রতিরোধের উদ্যোগ নেওয়া হত । একটি উঁচু টাওয়ার থেকে শহরের ওপর নজরদারি চালানোর ব্যবস্থা থাকত । নগরে প্রবেশের জন্য কয়েকটি মাত্র পথ থাকত । প্রধান প্রবেশপথে একটি ফটক তৈরি করা হত ।

2. পরিকল্পনার অভাব :-  মধ্যযুগের ইউরোপের নগরগুলি কোনো সুপরিকল্পিত চিন্তাভাবনা করে নির্মিত হয়নি । নগরগুলি ছিল অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ রাস্তাঘাট ও ঘরবাড়িগুলি অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত হত বলে শহরের জীবনযাত্রার মান বিশেষ ভালো ছিল না । শহরে পর্যাপ্ত স্থানের অভাবে মানুষকে সর্বদা এক ঘিঞ্জি পরিবেশে বসবাস করতে হত । প্রাচীরবেষ্টিত ছোট্ট অঞ্চলে একত্রে প্রচুর মানুষের বসবাসের ফলে মানুষের নাগরিক জীবনের মান ছিল খুবই নিম্ন ।

 3. রাস্তাঘাট :-  শহরের অভ্যন্তরে রাস্তাঘাটগুলি ছিল সরু ও আঁকাবাঁকা । অধিকাংশ রাস্তাই ছিল কাঁচা । রাস্তাগুলিরদুপাশে উঁচু উঁচু বাড়ি থাকায় দিনের বেলায়ও রাস্তায় পর্যাপ্ত আলো প্রবেশ করতে পারত না । রাস্তার পাশে নিকাশি ব্যবস্থাও ছিল অপর্যাপ্ত । ফলে শহরের সর্বত্র প্রচুর নোংরা শহরে আলোর কোনো ব্যবস্থা থাকত না । ফলে পথিক আগত্ত্বকদের প্রায়ই বিপদের সম্মুখীন হতে হত । শহরে অন্ধকার রাস্তায় নিরাপত্তার একমাত্র ভরসা ছিল লণ্ঠন ও

 4. ঘরবাড়ি :-  মধ্যযুগের শহরগুলির বেশিরভাগ ঘরবাড়ি রাস্তার দুপাশ ঘেঁষে তৈরি হত । উঁচু বাড়িগুলির ওপরতলার বর্ধিত অংশ প্রায়ই রাস্তার কিছুটা ভেতর পর্যন্ত অংশ দখল করে নিত । ধনীরা গৃহনির্মাণে প্রায়ই পৌৱ আইন লঙ্ঘন করত । ধনীদের বাড়িগুলি হত পাকা । দরিদ্রদের বাড়িগুলি কাঠ , খড় প্রভৃতি দিয়ে তৈরি হত । বেশিরভাগ একতলা বাড়িতে টালির ছাউনি থাকত । শহরের প্রধান সুন্দর অট্টালিকাগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল রোমান গির্জা ও টাউনহল ।

 5. পিল্ড বা সংঘ্য :-  এ যুগের শহরগুলির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল গিল্ড বা সংঘের অস্তিত্ব নিজেদের গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন বণিক ও কারিগররা শহরগুলিতে নিজ নিজ গিল্ড গঠন করত । গিল্ডগুলি শহরের বাণিজ্যিক কাজকর্ম পরিচালনা করত । তারা বণিক ও কারিগর উভয় পক্ষেরই যথাযথ স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করত । এ ছাড়াও গিল্ডগুলি শহরের সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট শহরে বিভিন্ন ধর্মীয় দুঃস্থ কারিগর ও তার প্রভাব বিস্তার করত । গিল্ডগুলি উৎসবের আয়োজন করত , পরিবারকে সহায়তা করত এবং শহরের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব পালন করত ।

6. ব্যাবসাবাণিজ্য :-  মধ্যযুগের শহরগুলি ইউরোপের ব্যাবসাবাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল । অসংখ্য বণিক , শিল্পী , কারিগর ও শ্রমিক এই শহরগুলিতে বসবাস করত । কারখানায় বা বাণিজ্যে কারিগর বা শ্রমিক হিসেবে কাজের আশায় গ্রামগুলি থেকে বহু কৃষক ও ভূমিদাস এসব শহরে চলে আসত । শহর থেকে বিভিন্ন কৃষি ও শিল্পসামগ্রী দেশ - বিদেশের দুরদুরান্তের বাজারগুলিতে চলে যেত ।

7. ধনী - দরিদ্রের ব্যবধান :-  শহরগুলিতে ধনী ও দরিদ্রের ব্যবধান ছিল তীব্র । প্রশাসন ও বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত বহু উচ্চশ্রেণির লোকজন ও ধনী বণিক শহরে বসবাস করত । নাগরিক জীবনের সুখসুবিধা লাভের আশায় সামন্তপ্রভুরাও পরবর্তীকালে শহরে বসবাস করতে শুরু করে । শহরে বসবাসকারী এসব ধনী ও উচ্চবিত্তরা খুব দামি পোশাক পরত এবং অত্যন্ত বিলাসিতায় দিন কাটাত । শৌখিনতা ও আড়ম্বর ছিল তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী । পাশাপাশি শহরে প্রচুর দরিদ্র কারিগর ও শ্রমিক বসবাস করত । তারা অত্যন্ত সাধারণ পোশাক পরত এবং অনাড়ম্বরভাবে দিন কাটাত । দিবারাত্র কাজে নিযুক্ত থেকে তারা অবসর কাটানোর বিশেষ সময় পেত না ।

8. শিক্ষা শহরগুলিতে :-  শিল্প বাণিজ্যের যথেষ্ট প্রসার ঘটলেও লেখাপড়ার প্রচলন খুব একটা ছিল না । শহরের দরিদ্র শ্রেণির কাছ শিক্ষা - সংস্কৃতি ছিল এক বিলাসিতার শামিল । দরিদ্র শ্রেণির ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার কোনো সুযোগ ছিল না । মূলত ধনী বণিক পরিবারের সদস্যরাই শিক্ষা , সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে যুক্ত থাকত । তারা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করত এবং মঠের সাধুসন্ডদের শিক্ষক হিসেবে বিদ্যালয়ে এনে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করত ।

 9. বিনোদন শহরের :-  মানুষ বছরের বিভিন্ন সময়ে আনন্দ উৎসবে যোগ দিত । আনন্দ - উৎসবের প্রধান অঙ্গ ছিল মেলা । দেশ - বিদেশের বহু বণিক বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী এসব মেলায় বিক্রির উদ্দেশ্যে নিয়ে আসত । মেলা উপলক্ষ্যে বসত নানা ভেলকিবাজির আসর । জুয়াখেলা , মদ্যপান , কুকুরের লড়াই , মুরগির লড়াই প্রভৃতি ছিল মানুষের আনন্দ - বিনোদনের প্রধান উপাদান । তা ছাড়া বহু শহরে সাপ্তাহিক বাজার বসত । সাপ্তাহিক বাজারে কেনাকাটা শহুরে মানুষের বিনোদনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ।


 2. কোপারনিকাসের জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করো ।

👉 সাধারণ ধারণা ছিল যে পৃথিবী স্থির এবং সূর্য তার চারদিকে ঘুরছে । কিন্তু এই ভ্রান্ত ধারণাটির বিরুদ্ধে আধুনিককালে যে জ্যোতির্বিজ্ঞানী সর্বপ্রথম বিজ্ঞানসম্মত মতবাদ প্রকাশ করেন তিনি হলেন পোল্যান্ডের জ্যোতির্বিজ্ঞানী নিকোলাস কোপারনিকাস সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বব্রহ্মাণ্ড মতবাদের প্রথম আধুনিক প্রবক্তা । তিনি ' আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের জনক ' নামে পরিচিত ।


১৪৭৩-১৫৪৩ খ্রিস্টাব্দ

A. প্রথম জীবন :-  নিকোলাস কোপারনিকাস ১৪৭৩ • খ্রিস্টাব্দে পোল্যান্ডের টোরান ( Torun ) শহরে জন্মগ্রহণ করেন । শিক্ষাজীবনে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান , চিকিৎসাশাস্ত্র , আইন প্রভৃতি বিষয়ে যথেষ্ট পাণ্ডিত্য অর্জন করেন ।

1. প্রাথমিক ব্যর্থতা :-  শিক্ষকতার জীবনে তিনি মোটেই সফল ছিলেন না অস্পষ্টভাবে কথা বলার জন্য শ্রেণিকক্ষে ছাত্রদের পড়াতে তিনি ব্যর্থ ছিলেন । প্রথম বছর গ্রাজে তিনি কিছু ছাত্র পেলেও পরের বছর তাঁর কাছে কেউ পড়তে না আসায় তিনি কিছুটা বিভ্রান্ত পড়েন ।

 2. জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার সূচনা :-  পরবর্তীকালে তিনি পোল্যান্ডের ফ্রাউএনবার্গ - এর চার্চের কর্মকর্তা হিসেবে জীবনের বেশির ভাগ সময় অতিবাহিত করেন । ফ্রাউএনবার্গ - এর চার্চে দায়িত্ব পালনের সময় এখানে নিজস্ব সময়ের সবটাই তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের চর্চায় ব্যয় করেন । তিনি এমন এক বৈজ্ঞানিক বিস্ময় উদ্ঘাটনের পথে অগ্রসর হন যা মৌলিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভবিষ্যৎকে পালটে দেয় ।

B. সূর্যকেন্দ্রিক মতবাদ প্রচার :-  পৃথিবী , সূর্য , চন্দ্র ও অন্যান্য গ্রহনক্ষত্র সম্পর্কে প্লেটোর প্রাচীন ভ্রান্ত ধারণা নস্যাৎ করে কোপারনিকাস যুক্তিসংগত সঠিক ধারণা প্রকাশ করেন । কোপারনিকাস বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের গঠন সংক্রান্ত তার মতবাদ ব্যাখ্যা করেন De revolutionibus orbium coelestium ( On the Revolutions of the Celestial Spheres ) বা ' জ্যোতিষ্কসমূহের কক্ষপথের আবর্তন ' শীর্ষক গ্রন্থে । এই গ্রন্থটি ছয়টি ‘ বই ’ বা খণ্ডে বিভক্ত ।

     এই গ্রন্থে তিনি ব্যাখ্যা করেন যে , বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রে অবস্থান করছে সূর্য এবং সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহ - উপগ্রহগুলি নির্দিষ্ট বৃত্তাকার কক্ষপথে সর্বদাঘুরে চলেছে । তিনি বলেন যে , শুক্র ও মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান করছে পৃথিবীর কক্ষপথ । তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্র হিসেবে সূর্যের অবস্থান উল্লেখ করেছেন এইভাবে — 

“ ... এ সমস্ত কিছুর মধ্যস্থলে সিংহাসনে বিরাজ করিতেছেন সূর্য । অপরূপ শোভাময় এই মন্দিরে শ্রেষ্ঠতর আর কোন্ পীঠে এই জ্যোতির্ময় রূপকে অধিষ্ঠিত করা যাইত ? ... এই সূর্য যেন রাজসিংহাসনে আসীন , আর তাহাকে কেন্দ্র করিয়া আবর্তনরত গ্রহগুলি যেন তাঁহার সন্তান । রাজসিংহাসনে থাকিয়া তিনি এই সন্তানদের শাসন করেন । ” 

C. কোপারনিকাসের বিপ্লব :-  কোপারনিকাসের মতবাদ তাঁর জীবদ্দশায় সাধারণ মানুষকে বিশ্বাস করানো মুশকিল ছিল । মাত্র সমকালীন কয়েকজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী কোপারনিকাসের বক্তব্যের গুরুত্ব বুঝেছিলেন । তাঁর মতবাদের ভিত্তিতে ১৫৫১ খ্রিস্টাব্দে প্রাশিয়ার নতুন পঞ্জিকা রচিত হয়েছিল ।

      কোপারনিকাসের জ্যোতির্বিদ্যা - সংক্রান্ড মতবাদকে পরবর্তীকালে আরও এগিয়ে নিয়ে যান টাইকো ব্রাহে , জিওরদানো ব্রুনো , গ্যালিলিয়ো গ্যালিলি , স্যার আইজ্যাক নিউটন প্রমুখ । কোপারনিকাসের মতবাদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের গঠন সংক্রান্ত আধুনিক ধারণা ‘ কোপারনিকাসের বিপ্লব ' নামে পরিচিত । 

D. মৃত্যু :-  অবিবাহিত কোপারনিকাস সারাজীবন ধরে জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণায় অত্যন্ত ব্যস্ত ছিলেন । এই মহান জ্যোতির্বিজ্ঞানী ১৫৪৩ খ্রিস্টাব্দে ( ২৪ মে ) ফ্রমবুর্ক এ মারা যান । তাঁর মৃত্যুর বছরই তাঁর সারাজীবনের গবেষণালব্ধ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ।

     জানা যায় যে , যেদিন তিনি মারা যান সেদিন মৃত্যুর পূর্বে তাঁর হাতে গ্রন্থটির প্রথম মুদ্রিত কপি তুলে দেওয়া হয়েছিল । মৃত্যুর পর ফ্রাওয়েনবার্গের ক্যাথিড্রালে তাঁকে সমাহিত করা হয় ।

E. মূল্যায়ন :-  আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যার গবেষণায় কোপারনিকাসের অবদান অসীম । মূলত তিনিই সর্বপ্রথম বিশ্বব্রহ্মান্ডের সূর্যকেন্দ্রিক গঠনের ধারণা যুক্তি সহকারে মানুষের মধ্যে প্রচার করেন । কোপারনিকাসের মতবাদ তাঁর উত্তরসূরি জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাজে বিশেষ সহায়তা করে । অর্থাৎ ' কোপারনিকাসের পথপ্রদর্শনের ফলেই পরবর্তীকালের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বিশ্বব্রহ্মান্ডের গঠন সম্পর্কিত ধারণার পূর্ণ রূপদানে সক্ষম হয়েছিলেন ।



Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.