চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কী? এর উদ্দেশ্য কী ছিল? চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের শর্তগুলি (বৈশিষ্ঠ্য) উল্লেখ কর। ভারতের আর্থ-সামাজিক ইতিহাসে এই ভূমি-ব্যবস্থার গুরুত্ব আলোচনা কর।চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কী ? এর পটভূমি আলোচনা করো ।

অথবা

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পটভূমি ব্যাখ্যা কর এ প্রসঙ্গে ভারতের কৃষক সমাজের ওপর এই বন্দোবস্ত কীরূপ প্রভাব ফেলেছিল বর্ননা কর





উত্তর

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ঃঃ

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হল এক ধরণের ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থা ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্ণওয়ালিস বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় এই ভূমি-ব্যবস্থা চালু করেন পরবর্তীকালে বারাণসী, উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ ও মাদ্রাস প্রেসিডেন্সির কোনো কোনো অঞ্চলে এই ব্যবস্থা চালু করা হয়

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পটভূমি ঃঃ

কোম্পানির কর্মচারী ও ঐতিহাসিক আলেকজান্ডার ডাও ১৭৭২ সালে প্রথম চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কথা বলেন এরপর হেনরি পাত্তুলো, ড্যাক্রিস, টমাস ল প্রমুখ এই বন্দোবস্তের সপক্ষে যুক্তি দেখান

১৭৮৬ সালে কর্ণওয়ালিশ গভর্নর জেনারেল হয়ে ভারতে আসেন তিন বছর ধরে তিনি বাংলার ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে ব্যপক অনুসন্ধান চালান এরপর ১৭৯০ সালে দেশীয় জমিদারদের সঙ্গে দশ বছরের জন্য একটি বন্দোবস্ত করেন, যা দশসালা বন্দোবস্ত নামে পরিচিত সেই সঙ্গে জানিয়ে দেন, ইংল্যান্ডের কর্তপক্ষ অনুমোদন করলে এই বন্দোবস্তই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত-এ পরিণত হবে

 এই প্রসঙ্গে, কর্ণওয়ালিসের সঙ্গে তাঁর পরিষদের সদস্য জন শোর-এর মতপার্থক্য দেখা দেয় তিনি বলেন, এবিষয়ে আরও বিশদ তথ্য সংগ্রহ করা প্রয়োজন দশসালাকে স্থায়ী বন্দোবস্তে পরিবর্তন না করে, ধীরে ধীরে এ'কাজে এগোনো উচিত

 কিন্তু কর্ণওয়ালিস দাবি করেন, সরকারের হাতে যথেষ্ট তথ্য আছে তিনি যুক্তি দেন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হলে জমিদাররা কৃষকদের স্বার্থের দিকে আরও বেশি নজর দেবে ইংল্যান্ডের কতৃপক্ষ কর্ণওয়ালিসের অভিমতকে সমর্থন করেন ফলে ১৭৯৩ সালে দশসালা বন্দোবস্ত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হিসাবে ঘোষিত হয়

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের শর্তাবলি (বৈশিষ্ট্য) ঃঃ

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের শর্তগুলি লক্ষ্য করলে এর কিছু বৈশিষ্ট্য নজরে আসবে –
I. জমিদার-তালুকদাররা বংশানুক্রমিকভাবে জমি ভোগদখল করতে পারবে
II. জমিদার ইচ্ছামত জমি দান, বিক্রি বা বন্ধক রাখতে পারবে
III. ভূমিরাজস্বের পরিমাণ ১৭৯৩ সালের হারেই নির্ধারিত হবে
IV. নির্ধারিত রাজস্বের শতকরা ৯০ ভাগ সরকার ও ১০ ভাগ জমিদার পাবেন
V. সূর্যাস্ত আইন অনুসারে, জমিদাররা সরকারের প্রাপ্য রাজস্ব নির্দিষ্ট দিনে সূর্যাস্তের মধ্যে পরিশোধ করতে বাধ্য থাকবে
VI. নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রাজস্ব মেটাতে ব্যর্থ হলে জমিদারি বাজেয়াপ্ত করা হবে
VII. ভবিষ্যতে খরা, বন্যা, মহামারি বা অন্য কোনো প্রকৃতিক বিপর্যয়েও রাজস্ব মকুব করা হবে না

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উদ্দেশ্য ঃঃ

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের প্রধান উদ্দেশ্যগুলি হল –
A.  সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি এই বন্দোবস্তের মাধ্যমে ভারতে ইংরেজদের অনুগ্রহপুষ্ট একটি নতুন অভিজাত শ্রেণি তৈরি করা, যারা তাদের সমর্থক হিসাবে কাজ করবে
B.  আয় সুনিশ্চিত করা কোম্পানি আশা করেছিল, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের ফলে তারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিয়োমিতভাবে সঠিক হারে রাজস্ব পাবে ফলে তাদের আয়ের অনিশ্চয়তা দূর হবে
C.  বাজেট তৈরির সুবিধা আয় সুনিশ্চিত হলে বার্ষিক আয়ব্যয়ের বাজেট তৈরির কাজ সহজ হবে
D.  দেশের সমৃদ্ধি জমিদার জমির ওপর স্থায়ী অধিকার পেলে কৃষির উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বিনিয়োগ করবেন এতে দেশের সমৃদ্ধি বাড়বে এবং পরোক্ষে কোম্পানির লাভ হবে



ফলাফল / সুফল-কুফল / গুরুত্ব ঃঃ

বাংলার (ভারতের) ইতিহাসে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা কেননা, এই ব্যবস্থা বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার ভূমি ও আর্থ-সমাজিক ব্যবস্থায় এক বিরাট পরিবর্তন আনে এই পরিবর্তনকে ঐতিহাসিকগণ সুফল ও কুফল - এই দুভাগে বিভক্ত করেছেন

কুফল (কৃষকদের ওপর) ঃঃ

ঐতিহাসিক হোমস বলেছেন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ছিল একটি দুঃখজনক ভুল (The permanent settlement was a sad blunder) প্রকৃতপক্ষে, এই বন্দোবস্তের সুফল অপেক্ষা কুফলই বেশি ছিল
1)  কৃষকদের উচ্ছেদ এই বন্দোবস্তে জমিদার জমির মালিকানা পায়, কৃষকরা নয় ফলে, বেশি রাজস্বের আশায় জমিদার চাষিকে ঘন ঘন জমি থেকে উৎখাত করতে থাকে এজন্য পার্সিভ্যাল স্পিয়ার বলেছেন,চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দ্বারা কৃষকরা জমিদারের ভাড়াটে মজুরে পরিণত হয়
2)  রাজস্বের হার বেশি জমি জরিপ (জমির গুণাগুণ) না করেই রাজস্বের পরিমাণ ধার্য করা হয় ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজস্বের হার বেশি হয়ে যায়
3)  জমির উন্নতি ব্যহত চাষিরা জমির মালিকানা না পাওয়ায় তারা জমির উন্নতির জন্য বিশেষ চেষ্টা করত না। জমিদাররাও জমির উন্নতির চেয়ে নিজেদের বিলাসব্যসনে বেশি অর্থ ব্যয় করত বলে কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন।
4)   কৃষকের দুরাবস্থা। জমিদাররা কৃষকদের ওপর প্রবল অত্যাচার চালিয়ে নির্ধারিত রাজস্বের চেয়ে অনেক বেশি রাজস্ব আদায় করত পরিসংখ্যান বলছে, ১৭৯৩ সালে জমিদাররা নির্ধারিত ৩৫ লক্ষ পাউন্ডের জায়গায় ১ কোটি ৩৫ পাউন্ড রাজস্ব আদায় করে ফলে, কৃষকদের অবস্থা করুণ হয়ে ওঠে
5)  মহাজনী শোষণ অতিরিক্ত রাজস্বের চাপে কৃষকশ্রেণী মহাজনের কাছে ঋণ নিতে বাধ্য হয় ঋণ ফেরৎ নিশ্চিত করার জন্য মহাজনরা কৃষকদের অর্থকরী ফসল, যেমন – নীল, পাট, ইত্যাদি চাষে বাধ্য করেফলে কৃষির বাণিজ্যকরণ ঘটে এবং কৃষকদের খাদ্যাভাব প্রকট হয়
6)  পুরোনো জমিদারদের উচ্ছেদ সূর্যাস্ত আইন অনুসারে নির্দিষ্ট সময়ে রাজস্ব জমা না দিতে পারায় বহু পুরোনো জমিদার তাদের জমি হারান প্রথম কুড়ি বছরের মধ্যে বাংলার প্রায় অর্ধেক জমিদার জমি হারান
7)  নতুন জমিদারের উত্থান পুরোনো জমিদারদের জমিদারি নিলামে উঠলে শহুরে ধনী বনিকরা সেই জমিদারি কিনে নেয় এইসব ভুঁইফোড় জমিদারদের জমি কিম্বা কৃষকদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না প্রজা শোষণ করে প্রচুর অর্থ উপার্জনই ছিল তাদের প্রধান লক্ষ্য
8)  মধ্যস্বত্বভোগীর উত্থান চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে বিভিন্ন মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির উদ্ভব ঘটে এরা পত্তনিদার,দর-পত্তনিদার, ইত্যাদি নামে পরিচিত এদের সীমাহীন শোষণ চাষ ও চাষিকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়
9)  শিল্প-বাণিজ্যের ক্ষতি শহুরে বণিকরা শিল্প-বাণিজ্য ছেড়ে জমিদারি ক্রয়ে মনোযোগ দিলে বাংলার দেশীয় শিল্প-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়ে কুটিরশিল্পের কাজেও মানুষ আগ্রহ হারায়
10) সরকারের ক্ষতি সরকারের রাজস্ব নির্ধারণ সুনির্দিষ্ট হওয়ার ফলে ভবিষ্যতে রাজস্ব থেকে আয় বৃদ্ধির সম্ভাবনা বন্ধ হয়ে যায় পরে পতিত জমি উদ্ধার, কৃষিপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি প্রভৃতি কারণে জমিদারের আয় বাড়লেও সরকার সেই আয়ের কোনো অংশ পেত না


সুফল (কোম্পানি ও জমিদার) ঃঃ

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল সম্পর্কে ঐতিহাসিক মার্শম্যান বলেছেন, It was a bold, brave and wise measure.এই ব্যবস্থার সুফলগুলি হল –
A.  সুনির্দিষ্ট আয় এই বন্দোবস্তের ফলে জমিদারদের অবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হয় সরকারের নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব প্রাপ্তি সুনিশ্চিত হয় ফলে, সরকারের পক্ষে বার্ষিক আয়ব্যয়ের বাজেট তৈরি সহজ হয়
B.  উৎখাতের আশঙ্কার অবসান কৃষকের রাজস্বের পরিমাণ সুনির্দিষ্ট হয় ফলে, তারা ইজারাদারদের শোষণ এবং জমি থেকে উৎখাতের আশঙ্কা থেকে মুক্তি পায়
C.  কৃষির উন্নতি জমির উপর জমিদারের স্বত্ব বা অধিকার সুনিশ্চিত হওয়ায়, তারা জমি ও কৃষির উন্নতিতে যত্নবান হন
D.  অনুগত গোষ্ঠির উদ্ভব এই বন্দোবস্তের ফলে সরকারের অনুগত একটি জমিদার শ্রেণির উদ্ভব হয় ফলে, তাদের সমর্থনে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তি আরও সুদৃঢ় হয়

এপ্রসঙ্গে জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র দত্ত বলেন, ১৭৯৩ সালে প্রবর্তিত লর্ড কর্ণওয়ালিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ছিল ভারতে ব্রিটিশ জাতির গৃহীত পদক্ষেপগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাজ্ঞ ও সফল পদক্ষেপ

মূল্যায়ন

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বাংলা তথা ভারতের আর্থ-সামাজিক ইতিহাসের উপর, বিশেষত কৃষক সমাজের ওপর এই বন্দোবস্তের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়েছিল এপ্রসঙ্গে ঐতিহাসিক তারা চাঁদ যথার্থই বলেছেন, ‘The settlement destroyed the old village community, changed the property relations, created new social classes and caused a social revolution in the Indian countryside.’


Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.