অর্থমনর্থম || শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়

অর্থমনর্থম



চতুর্থ পর্ব



পরদিন বেলা সাড়ে আটটার সময় আমরা করালীবাবুর বাড়িতে উপস্থিত হইলাম। কয়েকজন পুলিস-কর্মচারী ও বিধুবাবু হাজির ছিলেন। ব্যোমকেশকে দেখিয়া বিধুবাবু একটু অপ্রস্তুত হইলেন, কিন্তু সে ভাব গোপন করিয়া গম্ভীর স্বরে বলিলেন, ‘ব্যোমকেশবাবু, আপনি শুনেছেন বোধহয় যে, সুকুমারকে অ্যারেস্ট করেছি। সে-ই আসল আসামী, তা আমি গোড়া থেকেই বুঝেছিলাম—আমি শুধু তাকে ল্যাজে খেলাচ্ছিলুম।’

‘বলেন কি?’ ব্যোমকেশ মহা বিস্ময়ের ভান করিয়া এমনভাবে বিধুবাবুর পশ্চাদ্দিকে দৃষ্টিপাত করিতে লাগিল, যেন খেলাবার যন্ত্রটা সত্য সত্যই সেখানে বিদ্যমান আছে। ইনস্পেক্টর,সাব-ইনস্পেক্টর হাসি চাপিবার চেষ্টায় উৎকট গাম্ভীর্য অবলম্বন করিয়া অন্যদিকে মুখ ফিরিইয়া লইল।

বিধুবাবু একটু সন্দিগ্ধভাবে বলিলেন, ‘আপনি আজ কি মনে করে?’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘কিছু না। শুনলুম,আর একটা নুতন উইল বেরিয়েছে—তাই সেটা দেখতে এলুম।’

উইল ব্যোমকেশকে দেখাইবেন কি না, তাহা কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া বিধুবাবু অনিচ্ছাভরে ফাইল হইতে একটা কাগজ বাহির করিয়া দিলেন। বলিলেন, ‘দেখবেন, ছিঁড়ে ফেলবেন না যেন। এই উইলটাই হচ্ছে সুকুমারের বিরুদ্ধে সেরা প্রমাণ। করালীবাবুকে খুন করবার পর এটা সুকুমার চুরি করে নিজের ঘরে এনে লুকিয়ে রেখেছিল—কোথায় রেখেছিল জানেন? তার ঘরে যে তিনটে ট্রাঙ্ক উপরো-উপরি করে রাখা আছে, তারই নীচের ট্রাঙ্কটার তলায়।’

ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল, ‘বাঃ, সবই যে মিলে যাচ্ছে দেখছি! কিন্তু একটা কথা বলুন তো, সুকুমার উইখানা ছিঁড়ে ফেললে না কেন?’

বিধুবাবু নাকের মধ্যে একপ্রকার শব্দ করিয়া বলিলেন, ‘হুঁ, সে বুদ্ধি থাকলে তো। ভেবেছিল, আমরা তার ঘর সার্চই করব না।’

‘সুকুমার কিছু বললে?’

‘কি আর বলবে! সবাই যা বলে থাকে, যেন ভারি আশ্চর্য হয়ে গেছে, এমনি ভাব দেখিয়ে বললে, ‘আমি কিছু জানি না।’

ব্যোমকেশ উইলখানা উল্টাইয়া দেখিয়া, সমুচিত শ্রদ্ধার সহিত তাহার ভাঁজ খুলিয়া পড়িতে আরম্ভ করিল। আমিও গলা বাড়াইয়া দেখিলাম, সাদা এক-তা ফুলস্ক্যাপ্ কাগজের উপর ছাপার অক্ষরে লখা রহিয়াছে—

‘অদ্য ইংরাজী ১৯৩৩ খৃষ্টাব্দের ২২শে সেপ্টেম্বর তারিখে, আমি সজ্ঞানে সুস্থ শরীরে এই উইল করিতেছি যে, আমার মৃত্যুর পর আমার সমস্ত স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি ও নগদ টাকা আমার কনিষ্ঠ ভাগিনেয় শ্রীমান ফণীভূষণ পাইবে। পূর্বে যে সকল উইল করিয়াছিলাম, তাহা অত্র দ্বারা নাকচ করা হইল। স্বাক্ষর—শ্রীকরালীচরণ বসু।’

উইল পড়িয়া ব্যোমকেশ লাফাইয়া উঠিল, দেখিলাম, তাহার মুখ উত্তেজনায় লাল হইয়া উঠিয়াছে। সে বলিল, ‘বিধুবাবু, এ কি আশ্চার্য ব্যাপার! উইল যে—’ বলিয়া কাগজখানা বিধুবাবুর সম্মুখে পাতিয়া ধরিল।

বিধুবাবু বিস্মিতভাবে সেটা আগাগোড়া পড়িয়া বলিলেন, ‘কি হয়েছে? আমি তো কিছু—’

‘দেখছেন না?’ বলিয়া স্বাক্ষরের নীচেটা আঙুল দিয়া দেখাইল।

তখন বিধুবাবু চক্ষু গোলাকৃতি করিয়া বলিলেন, ‘ওঃ, সাক্ষী—’

‘চুপ!’ ব্যোমকেশ ঠোঁটে আঙুল দিয়া ঘরের ভেজানো দরজার দিকে তাকাইল। কিছুক্ষণ উৎকর্ণভাবে শুনিয়া পা টিপিয়া টিপিয়া গিয়া হঠাৎ কবাট খুলিয়া ফেলিল।

মাখনলাল দরজায় কান পাতিয়া শুনিতেছিল, সবেগে পালইবার চেষ্টা করিল। ব্যোমকেশ তাহাকে কামিজের গলা ধরিয়া ঘরের মধ্যে টানিয়া আনিল; জোর করিয়া একটা চেয়ারে বসাইয়া দিয়া বলিল, ‘ইনস্পেক্টরবাবু, একে ধরে রাখুন—ছাড়বেন না। আর, কথা কইতে দেবেন না।’

মাখন ভয়ে আধমরা হইয়া গিয়াছিল, বলিল, ‘আমি—’

‘চুপ! বিধুবাবু একটা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে আনিয়ে নিন। আসামীর নাম দেবার দরকার নেই—নামটা পরে ভর্তি করে নিলেই হবে।’ বিধুবাবুর কানের কাছে মুখ লইয়া গিয়া খাটো গলায় বলিল, ‘ততক্ষণ এই লোকটাকে ল্যাজে খেলান—আমরা আসছি।’

বিধুবাবু বুদ্ধিভ্রষ্টের মত বলিলেন, ‘কিন্তু আমি কিছুই—’

‘পরে হবে। ইতিমধ্যে আপনি ওয়ারেন্টখানা আনিয়ে রাখুন। এস অজিত।’

দ্রুতপদে ব্যোমকেশ উপরে উঠিয়া গিয়া ফণীর কবাটে টোকা মারিল। ফণী আসিয়া দরজা খুলিয়া সম্মুখে ব্যোমকেশকে দেখিয়া ঈষৎ বিস্ময়ের সহিত বলিল, ‘ব্যোমকেশবাবু!’

আমরা ঘরে প্রবেশ করিলাম। ব্যোমকেশের ব্যস্তসমস্ত ভাব আর ছিল না, সে সাহস্যমুখে বলিল, ‘আপনি শুনে সুখী হবেন, করালীবাবুর প্রকৃত হত্যাকারী কে—তা আমরা জানতে পেরেছি।’

ফণী একটু মলিন হাসিয়া বলিল, ‘হ্যাঁ—সুকুমারদা গ্রেপ্তার হয়েছেন জানি। কিন্তু এখনও যেন বিশ্বাস করতে পারছি না।’

‘বিশ্বাস না হবারই তো কথা। তাঁর ঘর থেকে আর একটা উইল বেরিয়েছে।–সে উইলের ওয়ারিস আপনি!’

ফণী বলিল, ‘তাও শুনেছি। কথাটা শুনে অবধি আমার মনটা যেন তেতো হয়ে গেছে। তুচ্ছ টাকার জন্যে মামার অপঘাতে প্রাণে গেল।’ একটা নিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, ‘অর্থমনর্থম্! তিনি আমার সব সম্পত্তি দিয়ে গেছেন, এতেও আমি খুশি হতে পারছি না ব্যোমকেশবাবু। নাই দিতেন টাকা—তবু তো তিনি বেঁচে থাকতেন।’

ব্যোমকেশ বইয়ের শেলফটার সম্মুখে দাঁড়াইয়া বইগুলা দেখিতে দেখিতে অন্যমনস্কভাবে বলিল, ‘তা তো বটেই। পুত্রাদপি ধনভাজাং ভীতিঃ—শঙ্করাচার্য তো আর মিথ্যে বলেননি! এটা কি বই? ফিজিওলজি! সুকুমারবাবুর বই দেখছি।’ বইখানা বাহির করিয়া ব্যোমকেশ নামপত্রটা দেখিল।

ফণী একটু হাসিয়া বলিল, ‘হ্যাঁ—সুকুমারদা মাঝে মাঝে আমাকে তাঁর ডাক্তারি বই পড়তে দিতেন। কি আশ্চার্য দেখুন। এ বাড়িতে আমি সুকুমারদাকেই সবচেয়ে আপনার লোক মনে করতুম—এমন কি, দাদাদের চেয়েও—অথচ তিনিই—’

ব্যোমকেশ আরও কতকগুলি বই খুলিয়া দেখিয়া বিস্মিতভাবে বলিল, ‘আপনি তো দেখছি একজন পাকা গ্রন্থকীটি! সব বই দাগ দিয়া পড়েছেন।’

ফণী বলিল, ‘হ্যাঁ। পড়া ছাড়া আর তো কোনও অ্যামুজমেন্ট নেই—সঙ্গীও নেই। এক সুকুমারদা রোজ সন্ধ্যাবেলা খানিকক্ষণ আমার কাছে এসে বসতেন। আচ্ছা, ব্যোমকেশবাবু, সত্যই কি সুকুমারদা এ কাজ করেছেন? কোন সন্দেহ নেই?’

ব্যোমকেশ চেয়ারে আসিয়া বসিল, বলিল, ‘অপরাধীর বিরুদ্ধে যে সব প্রমাণ পাওয়া গেছে, তাতে সন্দেহের বিশেষ স্থান নেই। বসুন—আপনাকে সব কথা বলছি।’

ফণী বিছানায় উপবেশন করিল, আমি তাহার পাশে বসিলাম। ব্যোমকেশ বলিল, ‘দেখুন, হত্যা দু’রকম হয়—এক, রাগের মাথায় হত্যা, যাকে crime of passion বলে; আর এক, সঙ্কল্প করে হত্যা। রাগের মাথায় যে—লোক খুন করে, তাকে ধরা কঠিন নয়—অধিকাংশ সময় সে নিজেই ধরা দেয়। কিন্তু যে লোক ভেবে-চিন্তে নিজেকে যথাসম্ভব সন্দেহমুক্ত করে খুন করে, তাকে ধরাই কঠিন হয়ে পড়ে। তখন কে আসামী, তার নাম আমরা জানতে পারি না, পাঁচজন লোকের ওপর সন্দেহ হয়। এ রকম ক্ষেত্রে আমরা কোন্ পথে চলব? তখন আমাদের একমাত্র পথ হচ্ছে—হত্যার প্রণালী থেকে হত্যাকারীর প্রকৃতি বোঝবার চেষ্টা করা।

‘বর্তমান ক্ষেত্রে আমরা একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখতে পাচ্ছি—হত্যাকারী লোকটা একাধারে বোকা এবং চতুর। সে অত্যন্ত বুদ্ধিমানের মত খুন করেছে অথচ নির্বোধের মত খুনের যা-কিছু প্রমাণ নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে রেখে দিয়েছে। বলুন দেখি, সত্যবতী ছুঁচ দিয়ে খুন করবার কি দরকার ছিল? বাজারে কি ছুঁচ পাওয়া না? আর উইলখানা যত্ন করে লুকিয়ে রাখবার কোনও আবশ্যকতা ছিল কি? ছিঁড়ে ফেললেই তো সব ন্যাটা চুকে যেত। এ থেকে কি মনে হয়?’

ফণী হাতের উপর চিবুক রাখিয়া শুনিতেছিল, বলিল, ‘কি মনে হয়?’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘যে ব্যক্তি বুদ্ধিমান, সে বোকমির ভান করতে পারে। সুতরাং পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, আসামী যে হোক সে বুদ্ধিমান।

‘কিন্তু বুদ্ধিমান লোকও ভুল করে,বোকা সাজবার চেষ্টাও সব সময় সফল হয় না। এ ক্ষেত্রেও আসামী কয়েকটা ছোট ছোট ভুল করেছিল বলে আমি তাকে ধরতে পেরেছি।’

ফণী মৃদু স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, ‘কি ভুল সে করেছিল?’

‘বলছি।’ ব্যোমকেশ পকেট হাটকাইয়া একটা সাদা কাগজ বাহির করিল—‘কিন্তু তার আগে এ বাড়ির একটা নক্সা তৈরি করে দেখাতে চাই। একটা পেন্সিল আছে কি? যে কোনও পেন্সিল হলেই চলবে।’

ফণীর বিছানায় বালিশের পাশে একটা বই রাখা ছিল, তাহার ভিতর হইতে সে একটা লাল পেন্সিল বাহির করিয়া দিল।

পেন্সিলটা লইয়া ব্যোমকেশ ভাল করিয়া দেখিল, তারপর মৃদু হাস্যে সেটা পকেটে রাখিয়া দিয়া বলিল, ‘থাক, প্ল্যান্ আঁকবার দরকার নেই—মুখেই বলছি। অপরাধী ‍প্রধানত তিনটি ভুল করেছিল। প্রথমে—সে গ্রে’র অ্যানাটমির এক জায়গায় লাল পেন্সিল দিয়ে দাগ দিয়েছিল; দ্বিতীয়—সে বাক্স টানবার সময় একটু শব্দ করে ফেলেছিল; আর তৃতীয়—সে আইন ভাল জানত না।’

ফণীর মুখ হইতে সমস্ত রক্ত নামিয়া গিয়া মুখখানা একেবারে মড়ার মত হইয়া গিয়াছিল, সে অতি কষ্টে উচ্চারণ করিল,‘আইন জানত না?’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘না, আর সেই জন্যেই তার অতবড় অপরাধটা ব্যর্থ হয়ে গেল।’

শুঙ্ক অধর লেহন করিয়া ফণী বলিল, ‘আপনি কি বলছেন, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।’

ব্যোমকেশ ধীরে ধীরে বলিল, ‘সুকুমারবাবুর ঘর থেকে যে উইলটা বেরিয়েছে—উইল হিসেবে সেটা মূল্যহীন। তাতে সাক্ষীর দস্তখত নেই।’

মনে হইল, ফণী এবার মূর্ছিত হইয়া পড়িয়া যাইবে। অনেকক্ষণ কেহ কোনও কথা বলিল না; দৃষ্টিহীন শুঙ্ক চক্ষু মেলিয়া ফণী মাটির দিকে তাকাইয়া রহিল। তারপর দুই হাতে মাথার চুল মুঠি করিয়া ধরিয়া অর্ধব্যক্ত স্বরে বলিল, ‘সব বৃথা—সব মিছে—’ ব্যোমকেশবাবু, আমাকে একটু সময় দিন, আমি বড় অসুস্থ বোধ করছি।’

ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া ঘাড় নাড়িল, ‘আধ ঘণ্টা সময় আপনাকে দিলুম—তৈরি হয়ে নিন।’ দ্বার পর্যন্ত গিয়া ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ‘থিম্বলটা অবশ্য’ ফেলে দিয়েছেন; সেটা সুকুমারের ঘরে রেখে আসেননি কেন বোঝা যাচ্ছে না। তাড়াতাড়িতে আঙুল থেকে খুলতে ভুলে গিয়েছিলেন—না? তাই হবে। কিন্তু ক্লোরোফর্ম কার হাত দিয়ে আনালেন? মাখন?’

ফণী বিছানায় শুইয়া পড়িয়া বলিল, ‘আধ ঘণ্টা পরে আসবেন—’

দ্বার ভেজাইয়া দিয়া আমরা নীচে নামিয়া আসিয়া বসিলাম। মাখন তখনও ইনস্পেক্টর ও সাব-ইনস্পেক্টরের মধ্যবর্তী হইয়া দারুভুত জগন্নাথের মত বসিয়াছিল, ব্যোমকেশ ভীষণ ভ্রৃকুটি করিয়া তাহাকে প্রশ্ন করিল, ‘তুমি কবে ফণীকে ক্লোরোফর্ম এনে দিয়েছ?’

মাখন চমকাইয়া উঠিয়া বলিল, ‘আমি কিছু জানি না—’

‘সত্যি কথা বল, নইলে ওয়ারেন্টে তোমার নামই লেখা হবে।’

মাখন কাঁদিয়া ফেলিয়া বলিল, ‘দোহাই আপনাদের, আমি এ সবের মধ্যে নেই। ফণী বলেছিল রাত্রে তার ঘুম হয় না, একফোটা করে ক্লোরোফর্ম খেলে ঘুম হবে—তাই—’

‘বুঝেছি। একে এবার ছেড়ে দিতে পারেন, বিধুবাবু।’

মুক্তি পাইয়া মাখন একেবারে বাড়ি ছাড়িয়া দৌড় মারিল। ব্যোমকেশ বলিল, ‘ওয়ারেন্ট এসেছে?’

বিধুবাবু বলিলেন, ‘না, এই এল বলে। কিন্তু কার জন্যে ওয়ারেন্ট?’

‘করালীবাবুকে যে খুন করেছে তার জন্য।’

বিধুবাবু অতিশয় অপ্রসন্নভাবে মাথা নাড়িয়া বলিলেন, ‘ব্যোমকেশবাবু, এটা পরিহাসের সময় নয়। কমিশনার সাহেব আপনাকে একটু স্নেহ করেন বলে আপনি আমার ওপর হুকুম চালাচ্ছেন, তাও আমি সহ্য করেছি। কিন্তু তামাশা সহ্য করব না।’

‘তামাশা নয়—এ একেবারে নিরেট সত্যি কথা। শুনুন তবে—’ বলিয়া ব্যোমকেশ সংক্ষেপে সমস্ত কথা বিধুবাবুকে বলিল। বিধুবাবু কিছুক্ষণ বিস্ময়বিহুল হইয়া রহিলেন, তারপর ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বলিলেন, ‘তাই যদি হয়, তবে তাকে একলা ফেলে এলেন কি বলে? যদি পালায়?’

‘পালাবে না; সে নিজের অপরাধ স্বীকার করবে। আর সেইটেই আমাদের একমাত্র ভরসা; কারণ, তার অপরাধ আদালতে প্রমাণ করা বিশেষ কঠিন হবে। জুরীদের আপনি জানেন তো—তারা ‘নট্ গিল্টি’ বলেই আছে।’

‘তা তো জানি—কিন্তু—’ বিধুবাবুর আবার বসিয়া পড়িলেন।

ঠিক আধ ঘণ্টা পরে আমরা ফণী ঘরে এলাম। বিধুবাবু সর্বপ্রথম দরজা খুলিয়া গটগট্ করিয়া ঘরে ঢুকিয়াই থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িলেন।

ফণী বিছানয়া শুইয়া আছে, বিছানার পাশে তাহার ডান হাতটা ঝুলিতেছে; আর ঠিক তাহার নীচে মেঝের উপর পুরু হইয়া রক্ত জমিয়াছে। কব্জির কাটা ধমনী হইতে তখনও ফোঁটা ফোঁটা গাঢ় রক্ত ঝরিয়া পড়িতেছে।

কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘এতটা আমি প্রত্যাশা করিনি। কিন্তু এ ছাড়া তার উপায়ই বা ছিল কি?’

ফণীর বুকের উপর একখানা চিঠি রাখা ছিল; সেটা তুলিয়া লইয়া ব্যোমকেশ পাঠ করিল। চিঠেতে এই কয়টি কথা লেখা—

‘ব্যোমকেশবাবু,
চলিলাম। আমি খোঁড়া অকর্মণ্য, এখানে আমার অন্ন জুটিবে না—দেখি ওখানে জোটে কি না।
আমি জানি,মোকাদ্দমা করিয়া আপনারা আমার ফাঁসি দিতে পারিতেন না। কিন্তু আমার বাঁচিয়া কোনও লাভ নাই; যখন টাকাই পাইলাম না,তখন কিসের সুখে বাঁচিব?
মামাকে খুন করিয়াছি সেজন্য আমার ক্ষোভ নাই; তিনি আমাকে ভালবাসিতেন না, খোঁড়া বলিয়া বিদ্রুপ করিতেন। তবে সুকুমারদার কাছে ক্ষমা চাহিতেছি। কিন্তু তিনি ছাড়া দোষ চাপাইবার লোক আর কেহ ছিল না।
তা ছাড়া, তিনি ফাঁসি গেলে আর একটা সুবিধা হইত। কিন্তু যে কথা নিজের বিকলাঙ্গতার লজ্জায় জীবনে কাহাকেও বলিতে পারি নাই আজ আর তাহা প্রকাশ করিব না।
ক্লোরোফর্ম কোথা হইতে পাইয়াছি তাহা বলিব না; যে আনিয়া দিয়াছিল সে আমার অভিসন্ধি জানিত না। তবে পরে হয়তো সন্দেহ করিয়াছিল।
আপনি আশ্চার্য লোক, থিম্বলের কথাটাও ভুলেন নাই। সেটা সত্যই আঙুল হইতে খুলিতে ভুলিয়া গিয়াছিলাম; ঘরে ফিরিয়া আসিয়া চোখে পড়িল। সেটা এই ঘরেই আছে—খুঁজিয়া লইবেন। সেদিন রাত্রিতে সত্যবতীর ঘর হইতে থিম্বল আর ছুঁচ চুরি করিয়াছিলাম—সে তখন রান্নাঘরে ছিল।
আপনি ছাড়া আমাকে বোধহয় আর কেহ ধরিতে পারিত না কিন্তু তবু আপনাকে বিদ্বেষ করিতে পারতেছি না। বিদায়। ইতি—
বহুদূরের যাত্রী
ফণীভূষণ কর

চিঠিখানি বিধুবাবুর হাতে দিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘এখন সুকুমারবাবুকে ছেড়ে দেবার বোধহয় আর কোনও বাধা নেই। তাঁর ভগিনীকেও জানানো দরকার। তিনি বোধহয় নিজের ঘরেই আছেন।–চল অজিত


    পরবর্তী পৃষ্ঠা » 


    Comments :

  Your Name :


  Your Email: (required)


  Your Message: (required)

                                           


Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.