জাতির সংজ্ঞা, প্রকৃতি, জাতি ও রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য আলোচনা করো ।

জাতি : সংজ্ঞা
( Nation : Definition )

গার্নার -এর মতে, ব্যুৎপত্তিগত অর্থে জাতি হল এমন একটি জনসমাজ যা একই পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত । স্তালিন (Stalin) তাঁর মার্কসবাদ ও জাতিসমস্যা প্রবন্ধে বলেছেন, জাতি হল ঐতিহাসিকভাবে বিবর্তিত এমন একটি স্থায়ী জনসমষ্টি যা ভাষাগত ঐক্য, ভৌগোলিক সান্নিধ্য, অর্থনৈতিক সমস্বার্থ এবং সমরূপ মানসিকতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে এবং যা একটি সাধারণ সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে ।

আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা জাতি শব্দটিকে একটু ভিন্ন অর্থে প্রয়োগ করেন । তাঁদের মতে, জাতি হল "রাষ্ট্র সহ রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন জনসমাজ ।" গিলক্রিস্ট ( Gillchrist ) বলেছেন, "জাতি হল রাষ্ট্রের অধীনস্থ ঐক্যবন্ধ সুসংগঠিত জনসমাজ" । অধ্যাপক হায়েস (Hayes) প্রায় একইভাবে বলেন, একটি ঐক্যবন্ধ জাতীয় জনসমাজ যখন সার্বভৌমিকতা ও স্বাধীনতা অর্জন করে তখন তা জাতিতে পরিণত হয় । সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, রাজনৈতিক সচেতনতা বা পৃথক রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষা থাকলেই কোনো জনসমাজকে জাতি বলা যাবে না, জাতির মর্যাদা অর্জন করতে হলে সেই আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপায়িত করতে হবে অথবা রূপায়ণের জন্য সচেষ্ট হতে হবে ।

উদাহরণস্বরূপ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি একটি রাষ্ট্র ছিল, কিন্তু এর অধিবাসীদের মধ্যে শুধুমাত্র রাজনৈতিক বন্ধন ছাড়া অন্য কোনো বন্ধন না থাকায় এটি জাতিতে পরিণত হতে পারেনি ।



প্রকৃতি ( Nature ) ঃ

ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকেই 'জাতি' (Nation) শব্দটির ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। বলা হয় যে, 'নাসসিও' (Nascio) এই লাতিন শব্দটি থেকে ইংরেজী 'Nation' শব্দটির সৃষ্টি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট লাতিন শব্দটির অর্থ হল জন্মান। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে, 'নাসিও' (Natio) এই শব্দটির অর্থ হল জন্মগতভাবে বা জন্মগত বিচারে ঐক্যবদ্ধ এক মানবগোষ্ঠী। সুতরাং প্রচলিত মূলগত অর্থের বিচারে 'জাতি' কথার মানে হল প্রজননগত বা বংশগত বিচারে একটি জনগোষ্ঠী। কিন্তু এই জনগোষ্ঠী কোন রকম রাজনীতিক তাৎপর্যহীন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকের আগে অবধি 'জাতি' শব্দের কোন রকম রাজনীতিক ব্যঞ্জনা ছিল না। কিন্তু অতঃপর 'জাতি' শব্দটির সঙ্গে রাজনীতিক ধারণা সংযুক্ত হয়। এরপর থেকে ব্যক্তিবর্গ এবং গোষ্ঠীসমূহের শ্রেণীকরণ করা হয় জাতীয়তার বিচারে।



জাতি ও রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য ঃ


গিলক্রিস্ট বলেছেন, “বাস্তব বিচারে জাতি ও রাষ্ট্র অভিন্ন নয় ।” জাতি ও রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্যের বিষয়টিকে নিম্নলিখিতভাবে তুলে ধরা হল :


(১) জাতি হল একটি মনস্তাত্ত্বিক ধারণা, অপরদিকে রাষ্ট্র হল একটি রাজনৈতিক ও আইনগত ধারণা ।

(২) জাতি গঠনের ও রাষ্ট্র গঠনের উপাদান এক নয় । জাতি গঠনের জন্য সার্বভৌমিকতার প্রয়োজন নেই, কিন্তু রাষ্ট্র গঠনের অপরিহার্য উপাদান হল সার্বভৌমিকতা ।

(৩) জাতির আশা - আকাঙ্ক্ষা রাষ্ট্রের মাধ্যমে মূর্ত হয়; অপরদিকে রাষ্ট্রের ইচ্ছা সরকারের মাধ্যমে কার্যকর হয় । অন্যভাবে বললে, জাতির ক্ষেত্রে সরকার নামক প্রশাসনিক সংস্থাটি অপরিহার্য নয়; কিন্তু সরকার ছাড়া রাষ্ট্র অচল ।


(৪) জাতি ও রাষ্ট্রের সীমানা সবক্ষেত্রে সমানুপাতিক হয় না । জাতির সীমানা রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমানাকে অতিক্রম করতে পারে । আবার রাষ্ট্রের সীমানা জাতির সীমানাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে ।




বিভিন্ন মতবাদ ঃ

লর্ড ব্রাইস (Bryce) ও গিলক্রিস্ট (R. N. Gilchist):   লর্ড ব্রাইস বলেছেন: “জাতি হল রাষ্ট্রনীতিকভাবে সংগঠিত বহিঃশাসন হতে মুক্ত অথবা মুক্তিকামী একটি জনসমাজ ("...a nation is a nationality which has organised itself into a political body either independent or desiring to be independent.”)। গিলক্রিস্ট-এর মতানুসারে, জাতি বলতে রাষ্ট্রাধীন এক সুগঠিত জনসমাজকে বোঝায়। তিনি বলেছেন: “Nation...is the state plus something else, the state looked at from certain point of view, viz., that of the unity of the people organised into one state."


হায়েস ও গার্ণার : বর্তমানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাজনীতিক সচেতনতার উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। বস্তুত রাজনীতিক চেতনার গভীরতাই জাতিকে জাতীয় জনসমাজ থেকে স্বতন্ত্র করে। হায়েস (Hayes)-এর মতে একটি জাতীয় জনসমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে সার্বভৌম স্বাধীনতা অর্জন করলে জাতিতে পরিণত হয়। তিনি বলেছেন: “A nationality by acquiring unity and sovereign independence becomes a nation." গার্ণারের অভিমত অনুসারে জাতি বলতে বোঝায় রাষ্ট্রনীতিকভাবে সংগঠিত এক জনগোষ্ঠীকে। কেবলমাত্র আত্মিক বা সাংস্কৃতিক সূত্রে আবদ্ধ জনগোষ্ঠীকে জাতি বলা হয় না।


স্তালিনের অভিমত : মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ অনুসারে স্তালিন (J. V. Stalin) জাতির সংজ্ঞা ও প্রকৃতি ব্যাখ্যা করেছেন। 'মার্কসবাদ ও জাতিসমস্যা' শীর্ষক প্রবন্ধে স্তালিন জাতি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। তাঁর মতানুসারে জাতি হল একটি বিশেষ জনসমষ্টি। এই জনসমষ্টি ঐতিহাসিকভাবে গড়ে উঠে। তা ছাড়া এই জনসমষ্টি হল স্থায়ী। জাতির প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য হিসাবে তিনি অভিন্ন ভাষা, বাসভূমি, আর্থনীতিক জীবন, মানসিক গঠন ও সাধারণ সংস্কৃতির কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন: 'জাতি বলতে ঐতিহাসিকভাবে বিবর্তিত এমন একটি স্থায়ী জনসমাজকে বোঝায় যারা এক ভাষা, এক বাসভূমি, এক আর্থনীতিক জীবন ও এক মানসিক গঠনের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে এবং যার এই মানসিক গঠন সাধারণ সংস্কৃতির মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।


মার্কসীয় অভিমত :  মূলত আর্থনীতিক উপাদানের ভিত্তিতে ব্যাখ্যা : মার্কসীয় দর্শনে আর্থনীতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ইতিহাস ও যাবতীয় ঐতিহাসিক ঘটনার বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়। মার্কসবাদীরা জাত ও জাতীয় জনসমাজের বিষয়টিকেও মূলত আর্থনীতিক দিক থেকে বিবেচনা করে থাকেন। তবে আলোচ্য ধারণা দু'টি বিচার বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে মার্কসবাদীরা ভৌগোলিক, ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক উপাদানকেও গুরুত্ব দেন। তবে আর্থনীতিক উপাদানের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। মার্কসবাদীদের মতানুসারে আর্থনীতিক অখণ্ড বন্ধনের মাধ্যমে একটি জনগোষ্ঠী এক জাতি এক প্রাণে পরিণত হয়। একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে আর্থনীতিক চেতনা ও রাজনীতিক অগ্রগতি এক অভিন্ন মনস্তত্ত্বের সৃষ্টি করে। ঐতিহাসিক ঐতিহ্য ও জীবনযাত্রার সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে জনগোষ্ঠীর এই সাধারণ মনস্তত্ত্ব প্রকাশিত হয়। স্তালিন (Stalin) -এর মতানুসারে, ভাষা, বাসভূমি, আর্থনীতিক জীবন এবং নির্দিষ্ট জাতীয় সংস্কৃতি হিসাবে ব্যক্ত মননভঙ্গি—এই উপাদানগুলির সম্মিলনের মাধ্যমে ঐতিহাসিকভাবে গঠিত একটি স্থায়ী জনসমষ্টি হল জাতি’ (“A nation is a historically evolved stable community of language, territory, economic life and psychological make up manifested in a community of culture.")।

মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে জাতি বলতে যে জনগোষ্ঠীকে বোঝায় তা জাতীয় জনসমাজের থেকে অধিকতর স্থায়ী। লেনিন (V.I. Lenin) -এর মতানুসারে জাতির এই স্থায়িত্বের মূল কারণ হল গভীর আর্থনীতিক উপাদান (profound economic factors )।


মূল্যায়ন ঃ

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে, জাতি ও রাষ্ট্রের মধ্যে অনেক পার্থক্য বিদ্যমান, তবে এই পার্থক্যের বিষয়টিকে খুব বড়ো করে দেখা ঠিক নয় । বস্তুতপক্ষে এদের মধ্যে সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ এবং পরস্পরের পরিপূরক ।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.