নানকিং -এর সন্ধি ও তিয়েনসিনের সন্ধির মূল শর্ত এবং ঔপনিবেশিক ভারতে অবশীল্পায়নের কারনগুলি ব্যাখ্যা করো

  নানকিং -এর সন্ধি :-

          প্রথম আফিমের যুদ্ধ ও নানকিং - এর চুক্তি ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে বেআইনি ঘোষণা করলেও বাণিজ্যিক স্বার্থে এবং প্রচুর মুনাফার লোভে ইংল্যাণ্ড বেআইনি আফিং বাণিজ্য চালিয়ে যায় । ফলে ১৮৪০ স্টাব্দে আফিং ব্যবসাকে কেন্দ্র করে চিন ও ইংল্যান্ডের সংঘর্ষ বাধে যা প্রথম আফিমের যুদ্ধ নামে পরিচিত । ইউরোপীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ সম্ভব নয় বুঝতে পেরে চিন ব্রিটেনের সাথে স্বাক্ষর করে । এই চুক্তির দ্বারা প্রথম অসম চুক্তি ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্টের নানকিং - এর চুক্তি গুলি হল –


 ক ) চিন হংকং বন্দরটি ইংল্যান্ডকে ছেড়ে দেয় ।

 খ ) ক্যান্টন , সাংহাই , অ্যাময় , ফুচাও , নিংগপো— এই পাঁচটি বন্দর ইউরোপীয়দের বাণিজ্য ও বসবাসের জন্য খুলে দেওয়া হয় ।

 গ ) চিন ক্যান্টন বন্দরে বাজেয়াপ্ত আফিমের মূল্য , কো - হো - এর কাছে প্রাপ্য অর্থ এবং যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ ২১,০০০০০০ ব্রিটিশ স্টালিং পাউন্ড দিতে বাধ্য হয় ।

 ঘ ) ‘ কো - হং ’ প্রথা বাতিল হয় এবং চিনের সর্বত্র ইংরেজ বণিকদের পণ্য ক্রয়বিক্রয়ের অধিকার স্বীকৃত হয় ।


 তিয়েনসিন -এর সন্ধি :-

             দ্বিতীয় আফিমের যুদ্ধ ও টিয়েনসিন - এর চুক্তি : পিকিং - এ চূতাবাস নির্মাণ , কনসুলেট স্থাপন , ধর্মপ্রচারের স্বাধীনতা , শুষ্ক ব্যবস্থা নিজেদের অনুকূলে রাখা , চিনে আরও নতুন নতুন অঞ্চল বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্তকরণ প্রভৃতি দাবি আদায়কে কেন্দ্র করে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স চিনের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ সংঘটিত করে তা দ্বিতীয় আফিমের যুদ্ধ নামে পরিচিত । এই যুদ্ধে চিন পরাজিত হয়ে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে জুন মাসে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের সাথে টিয়েনসিনের অসম চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয় । এই সন্ধির শর্ত দ্বারা—


    ( ক ) বিদেশি বণিকদের জন্য চিনকে আরো ১১ টি বন্দর খুলে দিতে হয় ।

    ( খ ) বিদেশিরা চিনের যে কোনো জায়গায় ভ্রমণ ও বসবাসের অধিকার পায় ।

    ( গ ) আফিম ব্যবসাকে আইনসম্মত করা হয় ।

    ( ঘ ) বিদেশি ধর্মপ্রচারকরা চিনের সর্বত্র ধর্মপ্রচারের অধিকার পায় ।

    ( ঙ ) রাজধানী পিকিং - এ বিদেশি দূতাবাস স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় ।



ঔপনিবেশিক ভারতে অবশীল্পায়নের কারন গুলি ব্যাখ্যা করো ।

 👉 সূচনা :--

        অব - শিল্পায়ন কথার অর্থ হল শিল্পের অবনমন বা অধোগতি । ঔপনিবেশিক অর্থনীতির প্রভাবে উনিশ শতকে ভারতে প্রতিষ্ঠিত শিল্পগুলি ধীরে ধীরে ধ্বংসের সম্মুখীন হয় । এই ভাবে কোনো শিল্প যদি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় , অথচ সেই জায়গায় নতুন কোনো শিল্প গড়ে না ওঠে তার ফলে যে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তাকে অর্থনৈতিক ইতিহাসের পরিভাষায় অব - শিল্পায়ন বা Deindustrialisation বলে ।


অব - শিল্পায়নের কারণ :-  প্রাক্ - শিল্পবিপ্লব পর্যায়ে ভারতবর্ষে হস্ত ও কুটির শিল্পজাত সামগ্রী যথেষ্ট উন্নত ছিল । এইসব পণ্যদ্রব্যের চাহিদাও ছিল সারা ইউরোপ জুড়ে যথেষ্ট । ঢাকাই মসলিন গুণগত মানের জন্য পৃথিবী বিখ্যাত ছিল । ডেফো , তাঁর ‘ রবিনসন ক্রুশো গ্রন্থে দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন ' ইংল্যান্ডের ঘরে ঘরে , বসার ঘরে ও শোবার ঘরে সর্বত্র এই ভারতীয় পণ্য সামগ্রী প্রবেশ করেছে । কিন্তু ভারতে কোম্পানি শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে দেশীয় শিল্পের দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে এবং কালক্রমে তা ধ্বংস হয়ে যায় । দেশীয় শিল্পের ধ্বংসের এই কারণগুলি ছিল —

 ( ১ ) কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য :-- ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে দেওয়ানি লাভের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় অন্যান্য কোম্পানিকে হটিয়ে দিয়ে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে । বস্ত্রশিল্পের ক্ষেত্রে কোম্পানির মূলনীতি ছিল সবচেয়ে কম দামে এদেশের কাচামাল ক্রয় করে চড়া দামে তা ইউরোপের বাজারে বিক্রয় করা । এর ফলে ভারতীয় বস্ত্রশিল্প প্রায় ধ্বংসের সম্মুখীন হয় ।


 ( ২ )  তুলার দাম বৃদ্ধি :--  সুতিবস্ত্র তৈরির জন্য যে তুলার প্রয়োজন হয় , কোম্পানির


কর্মচারীরা তার উপর একচেটিয়া অধিকার স্থাপন করে তা, তাতিদের চড়া দামে বিক্রয় করত । চড়া দামে তুলো কিনে এবং কম দামে বস্ত্র বিক্রি করে তাঁতিরা স্বর্বস্বান্ত হত ।


( ৩ ) ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইন :--  ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইন দ্বারা ভারতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক চেটিয়া বাণিজ্যের অবসান ঘটলে ভারতের বাজারে ইউরোপীয় অন্যান্য বণিকদের অবাধ প্রবেশ ঘটে । ইউরোপে উৎপন্ন অনেক উন্নতমানের সস্তা দামের পণ্যে ভারতের বাজার ভরে যায় । 

 ( ৪ ) শিল্প বিপ্লবের প্রভাব :--  অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডে শিল্প - বিপ্লব ঘটে যাওয়ার ফলে অতি অল্প সময়ে অতি দ্রুত নানান উন্নত মানের দ্রব্যসামগ্রী উৎপন্ন হতে থাকে । ইংল্যান্ডে উৎপন্ন দ্রব্যসামগ্রীর সাথে প্রতিযোগিতায় ভারতে উৎপন্ন দ্রব্য হেরে যাওয়ায় তা ধ্বংসের সম্মুখীন হয় ।


( ৫ ) অসম শুল্ক নীতি :--  ইংল্যান্ডের জিনিসপত্র যাতে ভারতে অবাধে আসতে পারে তার জন্য কোম্পানি আমদানি শুল্ক কমিয়ে দেয় । অন্যদিকে অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে ব্রিটেনে ভারত থেকে রপ্তানি করা পণ্যের ওপর উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করা হয় ।

( ৬ ) দেশীয় নৃপতিদের পৃষ্ঠপোষকতার অভাব :--  পলাশির যুদ্ধের পর ভারতে রাজা , জমিদারসহ অভিজাত শ্রেণির ক্রম অবলুপ্তি ভারতীয় কুটিরশিল্পের উপর চরম আঘাত হানে । কারণ এতদিন পর্যন্ত তারাই ছিল ভারতীয় কুটিরশিল্পের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ।

 ( ৭ ) কোম্পানির শোষণ ও তার কর্মচারীদের অত্যাচার :--  উইলিয়াম বোল্টস্ তার রচনায় দেখিয়েছেন কীভাবে কোম্পানির কর্মচারী ও দালালরা তাঁতিদের অগ্রীম দাদন নিতে ও ভয় দেখিয়ে শুধুমাত্র ইংরেজ কোম্পানির জন্য সুতিবস্ত্র বুনতে বাধ্য করত ।

( ৮ ) শিল্প সংরক্ষণ নীতি :--  বিদেশের বাজারে ভারতীয় বস্ত্রশিল্পের জনপ্রিয়তার ফলে ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের কারখানায় মন্দা দেখা দেয় , শ্রমিক ছাঁটাই হয় , তাঁতিরা বেকার হয়ে পড়ে । ব্রিটিশ সরকার এই ঘটনা সুনজরে দেখেনি ।


Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.